পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৭৩

নজরে পড়েনি। ফলে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা প্রথমে আক্রমণের সুযোগ পেয়ে গেল। এ রকম আকস্মিক আক্রমণের জন্য ওরা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। কামাণ্ডার হেমায়েতউদ্বীনের দক্ষ পরিচালনায় মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান ও সাব-মেশিনগান দু'টি একই সঙ্গে ছিপগুলিকে লক্ষ্য করে অবিরল ধারায় গুলিবর্ষণ করে চলেছে। ওরা একটু বাদেই প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়ে তার প্রত্যুত্তরে রাইফেল চালাতে লাগল। কিন্তু ওদের মনোবল আগেই ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাছাড়া ওদের পুলিশ আর রাজাকারদের মধ্যে শৃঙ্খলা বলতে কোন কিছু ছিল না। তারা সবাই যে যার প্রাণ বাচাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। অপর দিকে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগান আর রাইফেলগুলি ওদের উপর অশ্রান্তভাবে মরণ-আঘাত হেনে চলেছে। এই প্রবল আক্রমণের মুখে ওরা সংখ্যায় বেশী হোলেও বেশীক্ষণ লড়াই চালিয়ে যেতে পারল না। ওরা প্রাণ বাঁচাবার জন্য নৌকা থেকে খালের জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। সৈন্য, পুলিশ আর রাজাকার সবাই এই একই পন্থা অনুসরণ করল। এইভাবেই হরিণাহাটি যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল, মুক্তিবাহিনীর জয়ধ্বনিতে হরিণাহাটির নৈশ আকাশ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে চলল।

 যুদ্ধের ফলাফল দেখে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। এত বড় সাফল্যের কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। পরদিন সকালবেলা নৌকার মধ্যে ও জলের ওপর শত্রুপক্ষের ৫০টি মৃতদেহ পাওয়া গেল। ১৮ জন তাদের হাতে বন্দী হয়েছে। বাকি সবাই প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মাত্র একজন মারা গেছে। তার নাম ইব্রাহিম। মুক্তিবাহিনী ওদের নৌকার ভেতর থেকে ৫টি রাইফেল ও বেশকিছু বুলেট উদ্ধার করল।

 এ-সম্বন্ধে কারও মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে, শত্রুরা পর পর দু'বার ঘা খেয়ে ক্ষান্ত থাকবে না, তাদের আক্রমণ আসন্ন। সেজন্য অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। পরদিন ১৬ই জুন তারিখ মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি খালের পূর্বদিকে কোদালধোয়া গ্রামে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোল। কিন্তু এই সংবাদটা শত্রুদের অগোচর রইল না। খবর পাওয়াটা গেল তারা সেদিনই তাদের বর্তমান ঘাঁটির দিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে। ওদের লঞ্চ সেখান থেকে এক মাইল দূরে পয়সারহাট বাজারে এসে ভিড়েছে। শত্রুদের লঞ্চ এই খালের উপর দিয়ে আসবে। মুক্তিযোদ্ধারা খালের দু'পাশে স্থানে স্থানে পজিশন নিয়ে তৈরি হয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এইভাবে ঘণ্টাখানেক সময় কেটে গেল, কিন্তু সেই লঞ্চটির আর দেখা নেই। শেষে খবর পাওয়া গেল যে, ওরা পয়সারহাট বাজারে খানাপিনার উৎসবে মেতে গেছে। এই বাজারে যে-সমস্ত খাদ্র-দ্রব্য মেলে ওরা তা জবরদস্তি করে লুটেপুটে নিচ্ছে।

 কমাণ্ডার হেমায়েতউদ্দীন স্থির করলেন, মুক্তিবাহিনীর একটা দল এখানেই মোতায়েন থাকবে। অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি দু’মাইল পথ এগিয়ে যাবেন এবং সেখানে গিয়ে লঞ্চসহ শত্রুদের ঘেরাও করে ফেলবেন। এই পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর দল সবেমাত্র কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছে, এমন সময় শত্রুসৈন্যবাহী লঞ্চটা তাঁদের কাছাকাছি এসে পৌঁছল। জায়গাটা এমন যে, সেখানে দাঁড়িয়ে পজিশন নেওয়ার খুবই অসুবিধা। কিন্তু উপায়ন্তর না থাকায় সেখানেই তাদের পজিশন নিতে হোল। শত্রুরা তাদের দেখতে পেয়েছে এবং দেখার সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুড়তে শুরু করে দিয়েছে। মুক্তিসেনাদের মেশিনগান ও রাইফেলের গুলিও তার প্রত্যুত্তর দিয়ে চলল। তাদের প্রবল গুলিবর্ষণের ফলে লঞ্চটা জায়গায় জায়গায় ভেঙেচুরে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত অবস্থা বেগতিক দেখে শত্রুরা তাদের লঞ্চ নিয়ে পৃষ্ঠভঙ্গ দেবার চেষ্টা করছিল। কমাণ্ডার হেময়েতউদ্দীন পলায়মান লঞ্চের পেছনে পেছনে ধাওয়া করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই লঞ্চ তাঁদের আক্রমণের নাগালের বাইরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘণ্টা দেড়েক ধরে এই যুদ্ধ চলেছিল। তাতে হানাদারদের মধ্যে ছয়জন সৈন্য নিহত ও অনেক সৈন্য আহত হয়।

 সেইদিনই বিকালবেলা দু'দল পাক-সৈন্য দু'দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে মুক্তিফ্রণ্টের ঘাঁটি কোদলধোয়া গ্রামটিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসতে থাকে। একটি দল মাদরীপুর থেকে স্পীডবোট বোঝাই করে আসছিল। তারা অনেক দূর পর্যন্ত চলে এসছিল বটে, কিন্তু তাদের দালালদের মুখে মুক্তিবাহনীর