পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৭৪

মেশিনগানের শক্তির পরিচয় পেয়ে তারা আর বেশীদূর এগুতে ভরসা করল না। শেষ পর্যন্ত তাদের মনের ক্ষোভ মেটাবার জন্য তারা পীড়ারবাড়ি গ্রামে হামলা করে, সেখানকার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে স্বস্থানে ফিরে গেল। অপরদিকে গৌরনদী, উজিরপুর, কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ থেকে চারটি স্পীডবোট বোঝাইকরে বহু পাক-সৈন্য আর একদিক দিয়ে কোদালধোয়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। মুক্তিফৌজ সামনে এগিয়ে গিয়ে এই হানাদার শত্রুদের প্রতিরোধ করে দাঁড়াল। দু'পক্ষে প্রবল সংঘর্ষ হয় এবং শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী শত্রুদের পয়সাহাট থেকে আট মাইল দূরে তাড়িয়ে দিয়ে জয়-গৌরবে ফিরে আসে। এই যুদ্ধে নয়জন পাক-সৈন্য মারা যায়।

গৌরনদীর প্রতিরোধ[১]

 ২৫শে এপ্রিল। মিলিটারী আসছে, গৌরনদীর সর্বত্র রব উঠল। সকাল থেকে চারখানা লেলিকপ্টার বেশ উঁচু দিয়ে বার বার মাদারীপুর থেকে যে রাস্তা গৌরনদীর বুক চিরে বরিশালের দিকে চলে গেছে তার উপর দিয়ে উড়ছে। ওদিকে বরিশাল শহরের চার মাইল উত্তরে জুনাহারে প্রচণ্ড গোলা বিনিয়ম হচ্ছে মুক্তি বাহনীর সাথে। কামানের গর্জন, গানবোটের শেলিং আর মর্টারের শব্দে থেকে থেকে খেঁপে উঠছে। অপর দিকে খবর পাওয়া গেল, মাদারীপুর দুদিন পূর্বে পাকবহিনী দখল করে নিয়েছে এবং আজকেই সড়কপথে দস্যুরা গৌরনদী হয়ে বরিশাল যাবে। কি করা যায় ভাবছে কৃষক-শ্রমিক আর রাজনৈতিক কর্মীরা। মুহূর্তের মধ্যে স্থির করে নিল তারা। যে করে হোক হানাদারদের বাধা দিতে হবে। অন্তত বাধা দেয়ার চেষ্টা করতেই হবে?। বীর যোদ্ধারা জানতো, সম্মুখযুদ্ধে কয়েকটা ৩০৩ রাইফেল আর পাঁচ-দশ রাউণ্ড করে গুলি দিয়ে ভারী অস্ত্রের সামনে কিছুই করা যাবে না। তবুও সাধারণ মানুষ যাতে ভেঙ্গে না গড়ে বা ভুল না বোঝে তার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। তাই তারা সকাল থেকে গৌরনদীর উত্তরে কটকস্থল নামক স্থানে পজিশনে রইল। ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে তবুও শত্রুর সাথে দেখা নেই।

 সকাল গড়িয়ে দুপুর। রৌদ্রের প্রখরতায় পিপাসাকাতর হয়ে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের গোপন অবস্থান থেকে (সিএণ্ডবি সড়কের পাশে) কয়েক গজের মধ্যেই সাধারণ কৃষক জহরউদ্দীন মোল্লার বাড়ী। তাই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পানি খাওয়ার জন্য জহর মোল্লার আঙ্গিনায় বিরাট বটগাছটার ছায়ায় বসলো। ওরা বিশ্রাম নিচ্ছে আর জহরউদ্দীন মোল্লা পানি ঢেলে দিচ্ছে। যেখানে বসে মুক্তিকামী ভাইয়েরা বিশ্রাম নিচ্ছিল তার থেকে কয়েক গজ উত্তরে একটা উঁচু পুল রয়েছে। এত উঁচু যে পুলের অপর দিক থেকে কিছুই দেখা যায় না। দুপুর গড়িয়ে বেলা তখন তিনটা। হঠাৎ করে শব্দ না করে একটা গাড়ী এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে। পরপর আরও কয়েকটা একেবারে গুনে গুনে চল্লিশটা। বর্বর সেনারা গুলি চালালো। বসা অবস্থায়ই শহীদ হলেন চারজন মুক্তিযোদ্ধা। শহীদ হলো জহরউদ্দীন মোল্লা ও তার ছেলে মোবারক মোল্লা। মুক্তিবাহিনীর হাতে সেদিন খতম হল দু'জন খানসেনা।

 সেদিন ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়া মুক্তিবাহিনী কয়েক দিনের মধেই আবার একত্রিত হল। এই একত্রিত করার পেছনে যাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ছিল তারা হলেন এস, এম রকিব, অধ্যাপক এনায়েত, সেণ্টু ও আরও কয়েকজন। তাদের প্রচেষ্টায় ২৪টা রাইফেল ও তিনশত রাউণ্ড গুলি দিয়ে প্রথম দল গঠন করা হয়। পরে এই দল মিলিত হয় গোপালগঞ্জের হেমায়েতের সঙ্গে।

 গৌরনদীর প্রতিরোধ সংগ্রামে আরও যাদের নাম অম্লান তাদের কথা কিছু লিখতেই হবে। এই দলটি সরিকলে ঘাঁটি করেছিল। এই দলটি খসরুর পার্টি নামে পরিচিত ছিল। এরা বয়সে তরুণ এবং সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক চেতনায় অনুপ্রণিত হয়ে একটি শক্তিশালী দল হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছিল। এরা সাধারণত হিট এ্যাণ্ড রান করে অনেক অস্ত্র পাক সৈন্য, পুলিশ ও রাজাকারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। বহু দালাল


  1. দৈনিক বাংলা, ২৪ মার্চ, ১৯৭২-এ প্রকাশিত মহীদ সেরনিয়াবাত রচিত প্রতিবেদনের অংশ।