পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৫

সারা শহর অন্ধকার, নীরব, নিথর ও নিস্তব্ধ। আনুমানিক মধ্যরাতে পাক হানাদাররা প্রথম রাজারবাগ পুলিশ লাইনের হাসপাতালের গেট (দক্ষিন দিক) থেকে গোলাবর্ষণ শুরু হয়। আমরা তার পাল্টা জবাব দেই। এবং পাক পশুদের প্রাণপণ প্রতিহত করার চেষ্টা করি। ওরা আমাদের লৌহকঠিন মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য ভারী অস্ত্র, শেল, কামান ও ট্যাংক ব্যবহার করে। আমাদের ওপর সাংঘাতিকভাবে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ হতে থাকে। আমরা প্রথমে আত্মসমর্পণ করিনি এবং আত্মসমর্পণ করার মতো কোনো দুর্বলতাও আমরা দেখাইনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের উদাত্ত আহ্বান অনুযায়ী আমরা আমাদের যার হাতে যে অস্ত্র ছিল তা দিয়ে সমস্ত পাক হানাদারদের প্রাণপণ প্রতিহত করার চেষ্টা করি। এবং এভাবে আমাদের সামান্য অস্ত্র নিয়ে পাক হানাদারদের প্রাণপণ প্রতিরোধ ও প্রতিহত করতে করতে আমরা জীবনদান করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে তখন পাক পশুদের মোকাবেলা করছিলাম। আমাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য ওরা গভীর রাতে রিজার্ভ অফিসের উত্তর দিকে টিনশেড ব্যারাকে লাইট বোম ও পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখানে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিল আমাদের এমন কতিপয় বীর সিপাহী নিদারুন ভাবে দগ্ধীভূত হয়ে শহীদ হন। অনেকে সাংঘাতিক ভাবে আহত হয়ে সেখানেই মৃতবৎ পড়ে থাকেন। আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকে এবং সমস্ত ব্যারাক পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। আমরা উপায়ান্তর না দেখে ছাদের উপর গিয়ে অত্মরক্ষা করতে থাকি। এবং পাক হানাদারদের প্রাণপণ প্রতিরোধ করতে থাকি। আমরা ব্যারাকের চারিদিকে লেলিহান আগুনের শিখায় কিছুমাত্র দমে যাইনি। আর আমাদের মনোবল কোনো সময়ই দুর্বল হয়ে পড়েনি। ওদিকে কামান, শেল আর ট্যাংকের গর্জন ও বৃষ্টির মত গোলাবর্ষণ চলছিল। কামান ও শেলের প্রচণ্ড আঘাতে আমাদের কয়েকটি পাকা ব্যারাকের প্রাচীরঘেরা মটর ওয়ার্কশপ মাটিতে ধসে পড়ে। ফলে আমাদের বীর সিপাহীরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নিজ নিজ সুবিধামত স্থান গ্রহণ করে চারদিকে জ্বলন্ত আগুন, অবিরাম শেলিং ও কামানের গর্জনের মধ্যে প্রাণপণ প্রতিরোধ করছিল পাক পশুদের। আমাদের অনেক বীর সিপাহীকে প্রতিরোধ করতে করতে শহীদ হতে আমি দেখেছি স্বচক্ষে। এমনি ভাবে পাক হানাদারদের প্রতিহত করতে করতে রাতের অন্ধকার কেটে যায়। ভোর হয়ে যায় এবং বেলা উঠে যায়। এরপর আমাদের গুলি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায় দেখে আমরা আর কোন উপায়ান্তর পাই না। ইতিমধ্যে পাক হানাদারদের হাজারো হুমকির মুখেও আমাদের মনোবল এতটুকু দুর্বল হয়ে পড়েনি। তারা ব্যারাকে ঢুকে আমাদেরকে বন্দী করে এবং ছাদের উপর থেকে আমাদেরকে নিচে নামিয়ে এনে বুটের লাথি এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে সজোরে এলোপাতারি আঘাত করতে শুরু করে। আকস্মকৎ এক হানাদার পাক পশু হাতের বন্দুক দ্বারা আমার মাথায় সজোরে আঘাত করলে আমার মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে এবং তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। তিন ঘণ্টা পড় আমি জ্ঞান ফিরে পাই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এমআই, এএসআই, হাবিলদার, সুবেদার, নায়েক, সিপাহীসহ আমরা প্রায় দেড়শত বীর যোদ্ধা পাক হানাদারদের হাতে বন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়। ২৯শে মার্চ বিকাল সাড়ে চারটায় ঢাকার তৎকালীন পুলিশ সুপার জনাব ই,এ, চৌধুরী রাজারবাগে আমাদের পুলিশ লাইনে আসেন এবং পাক হানাদারদের মেজরের সাথে কথোপকথনের পর আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়- “আব তুমলোগ চালা যাও, আয়েন্দা কাল ভোর ছয় বাজে মিল ব্যারাকমে তোমলোগ রিপোর্ট করেগা, আওর উহাই তোমলোগ রাহেগা ইদার হামলোগকা জোয়ান রাহেগা।”

সাক্ষাৎকারঃ আঃ গণি তালুকদার[১]

অফিস সহকারী (পুলিশ), রমনা থানা, ঢাকা (সদর)

৯-১-৭৪

 সিপাহী আবদুল খালেক, মোজাম্মেল হক, মুখলেসুর রহমান, মির্জা মহিউদ্দীন এবং আরও অন্যান্য বন্ধু ও সহকর্মীসহ আমরা ২৫শে মার্চ রাত দশটার সময় খাওয়া দাওয়া করে ১৪ নং ব্যারাকে বসেছিলাম। রাত পৌনে


  1. ১৯৭১সালের ২৫শে মার্চের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় রাজারবাগ (রিজার্ভ) পুলিশ লাইনে ওয়ারলেস অপারেটর ছিলেন।