পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৮০

মঙ্গলা পোর্টের বাহাদুর শ্রমিক ভাইয়েরা

 খুলনা জেলার মঙ্গলা পোর্ট। চালনার মতই এই বন্দরেও দেশ-বিদেশের জাহাজ যাতায়াত করে। রফতানির মাল জাহাজে ওঠে, আর আমদানির মাল জাহাজ থেকে নামে। কিন্তু অন্যান্য বন্দরের মত এখানে জাহাজ ভিড়াবার জন্য ডক ইয়ার্ডের ব্যবস্থা নেই। জাহাজগুলিকে মুরিং বয়ার সঙ্গে বেঁধে দিয়ে মালপত্রের ওঠানামা চলে।

 মঙ্গলা পোর্ট খুলনা শহর থেকে বহু দূরে। জলপথ ছাড়া সেখানকার সঙ্গে যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে মঙ্গলা পোর্টে যেন সব কিছু থেকে এক প্রান্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে। সারা প্রদেশজুড়ে স্বাধীন বাংলার আন্দোলন চলছে। কিন্তু এখানে তেমন কোন আন্দোলন নেই। তাহলেও এই বাংলাদেশের যেখানেই যত দূরেই থাকুক না কেন অন্দোলন প্রতিটি বাঙ্গালীর মনে সাড়া জাগিয়ে তুলেছে। মঙ্গলার অধিবাসীরাও এই বিষয়ে একেবারে উদাসীন হয়ে থাকতে পারে না। আমি এখানে বিশেষ করে নীচের তলার সাধারণ মানুষের কথাই বলছি। মঙ্গলা বন্দরের শ্রমিক ভাইয়েরা এই বিষয় নিয়ে চিন্তা না করে পারল না। এই নিয়ে তারা পরস্পরের মধ্যে নানারকম জল্পনা কল্পনা করে, কিন্তু এ সম্পর্কে তাদের কি করণীয় থাকতে পারে তা তারা ভেবে পায় না।

 ক'দিন হয় একটা ফ্ল্যাট এখানে এসে পাড়ে ভিড়েছে। সবাই লক্ষ্য করেছে, এই ফ্ল্যাটটার মধ্যে দশ- বারো জন পাঞ্জাবী সৈন্য আছে। এক এক করে ক'টা দিন কেটে গেল, কিন্তু ফ্ল্যাট যেমন ছিল তেমনি আছে।

 এমন তো কখনও হয় না। এই সৈন্যগুলি এখানে বসে বসে করছে কি! ওদের নিশ্চই কোন খারাপ মতলব আছে।.......

 শ্রমিক ভাইয়েরা অতি সতর্কভাবে ওদের হাল-চাল আর গতিবিধি লক্ষ্য করছিল। তারা দেখেছে, ফ্ল্যাটের সেই সমস্ত সৈন্যরা বড় হুঁশিয়ার, ওরা পালা করে সারা রাত জেগে পাহারা দেয়। ওটা কি শুধু আত্মরক্ষার জন্যই, না, এর পেছনে আরও কিছু আছে? শুল্ক অফিসে অনুসন্ধান নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পাওয়া গেল। এই ফ্ল্যাটে নাকি অনেক গোলাগুলি মজুদ করা আছে। এই সৈন্যরা তারই জিম্মাদার।

 খবরটা পেয়ে শ্রমিকরা অধীর হয়ে উঠল। এমন চমৎকার মওকা খুব কমই পাওয়া যাবে। এই সময় আক্রমণ করতে পারলে অতি সহজেই ওদের সব ক'টাকেই খতম করে দেয়া যাবে আর তারই সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণে গোলা-গুলি উদ্ধার করা যাবে। এইভাবে একবাণে দুই পাখি মারার এমন সুযোগ কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু কেমন করে এই কাজ হাসিল করা যাবে?

 অনেক চিন্তা ভাবনার পর অবশেষে একটা পথ পাওয়া গেল।

 এখানে বসে কোন কিছু করা যাবে না, মুক্তিবাহিনীকে খবর দিতে হবে। তারা অবশ্যই এর উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারবেই। কিন্তু কোথায় আছে মুক্তিবাহিনী, তারা কেমন করে তাদের সন্ধান পাবে? একজন বলল, সে শুনেছে, বাগেরহাট শহর এখনও নাকি মুক্তিবাহিনীর দখলে আছে। খবরটা সত্য কিনা, জোর করে বলা যায় না। তাহলেও একবার সেখানে গিয়ে চেষ্টা করে দেখা দরকার। তার এই প্রস্তাবটা সবাই একবাক্যে সমর্থন করলো।

 বাগেরহাট শহর এখান থেকে বত্রিশ মাইল দূরে। বর্তমানে নৌকা ছাড়া সেখানে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। যদি যেতে হয় এক্ষুনি যেতে হবে, একটুও দেরী করলে চলবে না। অবস্থা অত্যন্ত দ্রুত বদলে যাচ্ছে, পরে এমন সুযোগ নাও মিলতে পারে। যেমন প্রস্তাব তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন শ্রমিক নৌকা পথে বাগেরহাট রওয়ানা হয়ে গেলো।

 খবরটা মিথ্যে নয়। মুক্তিবাহিনী এখনও বাগেরহাট শহর অধিকার করে বসে আছে। বরিশালের প্রাক্তন সামরিক অফিসার মেজর জলিল এই মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এবং তিনিই ছিলেন তাদের পরিচালক। মঙ্গলার শ্রমিক ভাইয়েরা বাগেরহাট শহরে পৌঁছে তাঁর সাথে দেখা করল।