পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৮৩

প্রতিরোধ করার কোন অস্ত্র আমাদের হাতে ছিল না। নদীপথে গোয়ালন্দঘাট, গোপালগঞ্জ এবং মাদারীপুর ছাড়াও স্থলপথে পাংশা ও কামারখালীতে প্রতিরোধ গড়ে তোরা হয়, যাতে করে কুষ্টিয়া কিংবা যশোর হয়ে আক্রমণের সম্ভাবনা প্রতিহত করা যায়। দিবারাত্র চব্বিশ ঘণ্টা ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের কণ্ট্রোল রুম কর্মব্যস্ত থাকতো এবং সেখান থেকে তাৎক্ষণিক তদারকি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করা হোত। ফরিদপুর ছিল ভারত অভিমুখে শরণার্থীদের অনেকেরই মাঝপথ। অনেক নেতা ও কর্মী ঢাকা থেকে ভারত যাওয়ার পথে ফরিদপুরে বিশ্রাম নিয়ে যশোর হয়ে চলে যেতেন। এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অনেক নেতৃবর্গই ফরিদপুরে অবস্থান নিলেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর শহর থেকে লোকজন পরিবার-পরিজনসহ গ্রাম এলাকায় চলে যেতে লাগলেন। একটা আসন্ন সংঘাতের মুখোমুখি আমরা প্রশাসন কর্মকর্তা ও প্রতিরোধে নিয়োজিত নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা শহরে রয়ে গেলাম। আমরা শহরের প্রবেশের বিভিন্ন এবং রাস্তার উপর ব্যারিকেড তৈরী করলাম। ২১শে এপ্রিল ভোর রাতে হানাদার বাহিনী সুসজ্জিত গানবোট দিয়ে প্রথমে গোয়ালন্দঘাট আক্রমণ করল। আমাদের প্রতিরোধের কর্মীরা প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে আক্রমণ প্রতিহত করতে চেষ্টা করে, কিন্তু দূর থেকে অবিরাম মর্টার-এর শেল বর্ষণের মধ্যে সকাল নয়টায় হানাদার বাহিনী গোয়ালন্দঘাট দখল করল এবং একই সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে ফরিদপুরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে ছত্রী বাহিনী অবতরণ করতে লাগলো। নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ফরিদপুর শহর ত্যাগ করতে লাগলাম।

 আমি সকাল দশটার দিকে ইপিআর-এর একজন প্রতিরক্ষা কর্মী সদস্য কবিরুল আলমকে সঙ্গে নিয়ে নড়বড়ে একটা জীপে করে কামারখালীর দিকে রওয়ানা হলাম এবং কে, এম, ওবায়দুর রহমান নগরকান্দা হয়ে গোপালগঞ্জের দিকে রওয়ানা হলেন। অন্য নেতৃবৃন্দও বিচ্ছিন্নভাবে শহর ত্যাগ করলেন।

ফরিদপুর শহরে প্রাথমিক প্রতিরোধ[১]

 ২৬শে মার্চ রাত প্রায় ২/৩টার দিকে কোতোয়ালীর ও-সি আমাদের বাসায় আসেন। বাবা তখন এমএনএ আদিলউদ্দিন আহমেদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি এসে জানালেন ঢাকার অবস্থা খুবই খারাপ এবং ফরিদপুরের দিকে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে পাক-বাহিনী আসছে। এ অবস্থায় ও-সি সাহেব থানার চাবি আব্বাকে দিয়ে সরে যেতে চাইলেন। তখন আব্বা এ অবস্থায় থানার দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাইলেন না। এরপর আব্বা এবং আমি ডি-সি সাহেবের বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। ফরিদপুরের ডি-সি তখন জনাব এ, এম, এন, ইউসুফ। এস-পি ছিলেন মিহির সাহেব। উভয়কে আমরা ডি-সি সাহেবের বাসার অফিসে দেখতে পাই। ডি-সি সাহেবের সাথে ঢাকা এবং ফরিদপুরের অবস্থা নিয়ে আলাপ হয়। তিনি বললেন, এখনও যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে আর্মি আসছে। তারা আজকেই শহরে এসে পৌঁছাবে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতা এবং কর্মীদের শহর থেকে সরে যাওয়াটাই উচিত। তখন আমরা ঠিক করলাম যে, আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিদের সাথে যোগাযোগ করে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে। তখন তিনি গাড়ী পাঠালেন তাদেরকে আনার জন্য। জনাব শামসুদ্দিন মোল্লা (এমএনএ), জনাব হায়দার হোসেন (এমপি) এরা সবাই আসলেন। পরিস্থিতি জানার পরে আপতত শহর থেকে সরে যাওয়ার জন্য সকলেই সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর আমি একটি জীপসহ বেরিয়ে শহরের বিভিন্ন দলের ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ঢাকার ঘটনা জানাই এবং যশোর ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ফরিদপুরের দিকে সেনাবাহিনী আসার পথে বাধা দেওয়ার ব্যবস্থা করি। এতে ঐ সময়ে অনেকেই ব্যাপারটিকে অবাস্তব মনে করে প্রতিরোধে অংশীদার হতে চাইলেন না। কিন্তু সৈয়দ নাসির হোসেন আহমেদ, জামাল ও আরো কয়েকজন মিলে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, রাস্তায় বড় বড় গাছ কেটে সেনাবাহিনীর পথ রোধ করতে হবে। তখন গাড়ি


  1. প্রতিবেদনটি জানুয়ারী, ১৯৮৪-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আহমেদ কামাল-এর কাছ থেকে সংগৃহীত।