পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪০০

 এই বেতার বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তির জন্য এবং জয়ের জন্য প্রার্থনা করতে আহ্বান জানিয়েছে। ধিক্কার দিয়েছে বিশ্বাসঘাতক জঙ্গী স্বৈরতন্ত্রকে যারা দেশব্যাপী রক্তস্রোতের জন্য দায়ী। আর শেষে সাড়ে কোটি মানুষের হয়ে সমস্ত বিশ্বের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির জন্য আবেদন জানিয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা,৭ এপ্রিল, ১৯৭১

সোমবার জয়-বাংলার জয়ের পালা

 রংপুর, কুমিল্লা ময়মনসিংহ মুক্ত, তিস্তা সেতু ধ্বংসঃ সোমবার জয় বাংলার শুধু জয়ের মালা, একটার পর একটা জয়ের পালা জয় রংপুর শহর-অধিকৃত। জয় কুমিল্লা শহরেও-মুক্ত। শ্রীহট্টের বিমানক্ষেত্রও মুক্তিফৌজের করারত্ত। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও ফরিদপুরে মুজিব সেনারই জয়জয়কার। সংগ্রামী সেনারাই দিন এই প্রথম সব রণাঙ্গন মিলিয়ে একটি যুক্ত কমাণ্ড গড়ে তোলার পথে পা বাড়ান। এই উদ্যোগ হানাদার হটানোর লড়াইয়ে শেষ রাউণ্ডের প্রস্তুতি।

 মুক্তিফৌজ হানাদারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া সাঁজোয়া গাড়ি, মেশিনগান ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নরসিংদী (ঢাকা থেকে ১৪ কি.মি.) অভিযানে এগিয়ে চলেছেন। শ্রীহট্ট শহরের একাংশ এবং ছাউনি এলাকা বাদে পাবনা ও বগুড়ার প্রায় সব অঞ্চলই হানাদারমুক্ত।

 পাকফৌজ ও হানাদার বিমান বাহিনীর তৎপরতা রোধের জন্য মুক্তিসেনারা পোড়ামাটি নীতি অনুসারে তিস্তা সেতু ধ্বংস করেছেন। অকেজো করে দিয়েছেন লালমনিরহাট বিমানক্ষেত্র, উড়িয়ে দিয়েছেন ঢাকা-শ্রীহট্ট রেলপথের (৪৮০ কিলোমিটার) বহু গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানী ফৌজ গর্তে তাড়া খাওয়া সাপের মত ছড়িয়ে পড়েছে রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও শ্রীহট্ট আর মার খাওয়া সাপের মতই ছোবল মারছে যত্রতত্র, যা পাচ্ছে তাই ধ্বংস করছে কামান দিয়ে, মেশিনগান দিয়ে, পেটরোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে। অত্যাচার চালাচ্ছে বিশেষ করে নারীদের ওপর।

 রংপুর পাকিস্তানীদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের দরুণ লড়াই হয়েছে। দু’পক্ষের হতাহতের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুক্তিফৌজই জয়ী। দখলদারদের হাত থেকে তাঁরা রংপুর শহর পুনর্দখল করেছেন। রংপুর শহরের কাছেই তিস্তা সেতু মুক্তিফৌজ সেটি ধ্বংস করে দিয়েছেন। লালমনিরহাট বিমানক্ষেত্রটিও তারা অকেজো করে দিয়েছেন। সেতুটি ধ্বংসের ফলে পাকিস্তানীর পালাবার পথ নেই। অন্য সমস্ত পথ মুক্তিফৌজ আগেই বন্ধ করে দিয়েছেলেন।

 শ্রীহট্টেও পাকফৌজের সরবরাহের পথগুলি একে একে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সেখানেও তারা প্রচণ্ড অসুবিধার সম্মুখীন। সবত্রই মুক্তিফৌজ দখলদারদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশী। ঢাকা-শ্রীহট্ট রেলপথ এখন ব্যবহারের অযোগ্য। শ্রীহট্টের শালুটিকর বিমানক্ষেত্রটি মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর দখল করে নিয়েছেন। শ্রীহট্টের শহর ছাড়া ওই জেলার কোথাও পাকফৌজের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। হরিপুর (ভারত সীমান্ত থেকে ২৯ কি.মি.) পাকিস্তান পেটরোল লিঃ এর তৈলকেন্দ্রটি মুক্তিফৌজ শনিবার উড়িয়ে দিয়েছিলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সেখানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।

 লালমনিরহাট পাকফৌজের দখলে আছে। পাক বিমান বাহিনীর মদতে তারা সেখানে আছে। আনন্দবাজারের সংবাদদাতা কোচবিহার থেকে জানিয়েছেন যে, পাকিস্তানীরা লালমনিরহাট প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করেছে। কোচবিহারে বাংলাদেশ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার উদ্বাস্তু এসেছেন। তারা সবাই মুসলমান।

 বাংলাদেশের তিন সেনাপতিঃ বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকা ও শহর ছাড়া প্রায় সবটাই এখন মুক্তিফৌজের দখলে ও প্রশাসনে। এই প্রশাসনে তিনটি সেকটরের নেতৃত্ব করছেন তিনজন সেনাপতি।