পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২০

লাঠি ছিল তাদের চলে যেতে বলি আত্মরক্ষার জন্য। আমি আমার ফোর্স নিয়ে মিরপুর ইটখোলার ভিতরে পজিশন নিয়ে পাক পশুদের অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা পালাই-নাই। কারণ পালাবার ইচ্ছা আমাদের ছিল না। আমরা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দৃঢ় শপথ নিয়েছিলাম। সামান্য রাইফেল নিয়েই আমরা পশুদের প্রতিরোধ করবো। প্রতিহত করবো, লড়বো কিন্তু পিছু হটবো না। সারারাত আমি আমার সশস্ত্র ফোর্স নিয়ে সেই ইটখোলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে পজিশন নিয়ে বসেছিলাম। আর ঢাকার আকাশে দেখছিলাম আগুনের লেলিহান শিখা, সকল নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার সহিত পাক পশুদের কামান ও ট্যাংক যুদ্ধের তাণ্ডবলীলা। রাত তিনটার সময় আমরা দেখছিলাম আমাদের চোখের সম্মুখে চারটি সশস্ত্র পাক সেনাদের ট্রাক চলে গেল। ট্রাকের পিছনে পিছনে যাচ্ছিল কামান বসানো ‘ডজ’। মিরপুর ইপিআর বাহিনীর সাথে আমরা পাক আর্মিদের এক ঘণ্টা তুমুল সংঘর্ষ দেখলাম। কামান ও ট্যাংকের কানফাটা গর্জনে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে পড়ছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম পাক আর্মি সেই সশস্ত্র ট্রাকগুলো নিয়ে ফিরছে তার পিছনে আরও তিনটি ট্রাক আসছিল। ঐ অতিরিক্ত ট্রাকে ছিল সংঘর্ষে পর্যুদস্ত বাঙ্গালী ইপিআর বন্দীরা। আমাদের সম্মুখ দিয়েই পাক পশুদের সশস্ত্র ট্রাকগুলি ইপিআর বন্দীদের নিয়ে সদর্পে এগোচ্ছিল। আমি আমার সিপাহীদের ওদের ওপর গুলি বর্ষণ করতে নিষেধ করেছিলাম। ওদের গাড়ীগুলো এগোচ্ছিল-সবাই চলে গেল। পিছনে দুটি গাড়ী থাকতেই আমার এক সিপাহী হঠাৎ ওদের প্রতি গুলিবর্ষণ করতেই ওরা সবাই ট্রাক থামিয়ে নেমে পড়ে কুকুরের মতো। ভীষণ ব্রাশ ফায়ার শুরু হয়ে যায় আমার সিপাহীদের উপর। আমাদের উপর পড়ছিল অসংখ্য গ্রেনেড, আরোও পড়েছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান থেকে বৃষ্টির মতো অসংখ্য গুলি। আমরা আমাদের সামান্য রাইফেল নিয়েই পশুদের প্রাণপণ প্রতিরোধ করতে থাকি। কিছুক্ষণ পর আমাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে আমরা গুলিবর্ষণ করতে করতে আস্তে আস্তে পিছু হটতে থাকি-আমাদের হাতে সামান্য রাইফেল থাকলেও ওরা রাতের কালো অন্ধকারে সেই ভারী কামান, ট্যাংক বহর ও অসংখ্য মেশিনগান, গ্রেনেড ও সশস্ত্র সৈন্য নিয়েও আমাদের সামনে সদম্ভে এগিয়ে আসতে সাহস পায় নাই। আমাদের দুর্জয় মানসিক শক্তির সামনে ওরা প্রথমত আসতে সাহস পায় নাই। সামান্য রাইফেল দিয়েই ওদেরকে প্রায় এক ঘণ্টা প্রতিরোধের পর আমি আমার ফোর্স নিয়ে পিছু হটছিলাম। আমার ফোর্স সব পিছনে চলে গিয়েছিলো। আমি আমার দুর্জয় সিপাহী নিয়ে একাই ওদের বিরুদ্ধে ফাইট দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ওরা নীরব-ওদের নীরবতা দেখে আমি ওদের ঘেরাওয়ের মাঝে পড়ে যাওয়ার ভয়ে পিছু হটে চলে আসি। পিছনে এসে দেখলাম এক প্রাসাদের ছাদের উপর এক বিদেশী দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার গেটের সামনে যাওয়ার সাথে সাথে সেই বিদেশী ভদ্রলোক এসে আমাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বিল্ডিংয়ের পিছনে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দিলেন। কিন্তু সে জায়গা নিরাপদ মনে না করায় আমরা সেই ভদ্রলোকের পরামর্শ অনুযায়ী তার বিল্ডিংয়ের পিছনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার এক সিপাহীর কথামত আমরা সবাই নিকটবর্তী অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মান্নান সাহেবের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেই। তিনি আমাদিগকে যথেষ্ট যত্ন করেন। আমরা তার বাড়িতে চা-নাস্তা খেয়ে তার ছাদের উপর গিয়ে দেখলাম পাক আর্মিরা ইটখোলার ভিতর ঢুকে আমাদিগকে সার্চ করছে, তখন ভোর হয়ে গিয়েছিল। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার তার বাসা থেকেই ধেয়ে আসতে থাকা পাক আর্মিদের বিরুদ্ধে ফাইট দিতে বলেন কিন্তু আমার সিপাহীদের গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় এবং আমরা রাতের ফাইটে সাংঘাতিকভাবে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় কল্যাণপুরের বাঙ্গালী এলাকায় চলে গিয়ে পুলিশের পোশাক ফেলে দিয়ে কলোনীর বাঙ্গালী ভাইদের দেওয়া ছেঁড়া লুঙ্গি গেঞ্জি পরে কল্যাণপুর কলোনীর ছাত্র-জনতার সাথে মিশে গিয়ে সেখানকার বাঙ্গালী জনতাকে সর্বতোভাবে সাহস দিতে থাকি। সকাল তখন দশটা বেজে গিয়েছিল। আমি আমার হাতে রাখা অচল অয়ারলেস সেটটা মেরামত করে সচল করে দিয়ে ঢাকার সব পুলিশ সেক্টর ডেড দেখলাম। মিরপুর থানার সহিত লাইন দিলাম, সেখান থেকে এক বাঙ্গালী কণ্ঠ ভেসে আসছিল- জোর করে স্বাভাবিক করা সেই কণ্ঠ বলছিলো, “মিরপুর থানা,” পরক্ষণেই এক অবাঙ্গালী পাকসেনা অয়ারলেস সেটে বলে ওঠে-কোন শালা কাহা তোম বোলতা হায়।” আমি বেশ বুঝতে পারি অয়ারলেসে বাঙ্গালী কণ্ঠ শোনা গেলেও