পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২১

সেখানে পাক সেনাদের প্রভুত্ব বহাল রয়েছে। আমি এরপর আমার অয়ারলেস সেটটি অচল করে কল্যাণপুর কলোনীর এক বাঙ্গালীর বাসায় রেখে পার্শ্ববর্তী মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। মসজিদে জনতার ব্যাকুল চাহনী কিছুতেই এড়াতে পারলাম না। নামাজ শেষে বের হয়ে এসে পাশের এক ছোট ঘরে বসে আছি এমন সময় দেখলাম অসংখ্য দাঙ্গাবাজ বিহারী লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে, পিছনে পাকসেনাদের গাড়ী। বিহারীরা সেখানে এসেই বাঙ্গালী কলোনীতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে লুটপাট শুরু করে দিল। ইতিমধ্যে পাক সেনাদের গাড়ী দুটো বিহারীদের বাঙ্গালী কলোনীতে লুণ্ঠনে লাগিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আমরা বিহারীদের তাণ্ডবলীলা আর সইতে পারলাম না- আমি আমার সিপাহীদের পজিশন নিয়ে বিহারীদের উপর ফায়ার করার নির্দেশ দিলে দুজন বিহারী গুলি খেয়ে পড়ে যায় আর সব বিহারী দৌড়ে পালিয়ে যায়। তখনকার মত কল্যাণপুর বাঙ্গালী কলোনী বেঁচে যায় বিহারী লুণ্ঠন থেকে। আমাদের গুলিবর্ষণে বাঙ্গালী কলোনীতে আসন্ন পাক ও বিহারীদের হামলা ও লুণ্ঠনের আশংকায় সবাই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পাগলের মতো পালাতে থাকে চারিদিকে। এরপর আমি মিরপুরের রাস্তার সামনে নদী পার হয়ে গ্রামের দীর্ঘ রাস্তা ধরে আমাদের সিপাহীদের নিয়ে অজানার পথে অদৃশ্য হয়ে যাই।

ঢাকা শহরে সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ (অবঃ) আনোয়ার হোসেন

 অসহযোগ আন্দোলনে আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল। আমি ঢাকা সেনানিবাসে দ্বিতীয় বেঙ্গলে ছিলাম।

 ২৫শে মার্চের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠি। আমার বাঙ্গালী অফিসারদের সাথে কথা বললে তারা আমাকে নিরুৎসাহিত করেন। তারপর আমরা ১৬জন যুবক আলাপ-আলোচনা করে ২৭শে মার্চ সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যাই। তেজগাঁ ড্রাম ফ্যাক্টরীর কাছে এসে দেখি মুক্তিবাহিনী গঠন হয়েছে। সেখানে ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক সবাই ছিল। আমি দলের নেতৃত্ব হাতে নেই। আমরা ৩৫০ জনের উপরে ছিলাম। তেজগাঁ রেল লাইনের অপরদিকে ডিফেন্স নিয়ে ২৯শে মার্চ পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হই। ১২৬ জন পাক সেনা হতাহত, ৩টি গাড়ী ধ্বংস এবং অনেক আহত হয়। বহু অস্ত্রও আমরা উদ্ধার করি। অস্ত্র দ্বারা আমরা পুনর্গঠিত ও নববলে বলীয়ান হই। ৩০শে মার্চ ঢাকার মহাখালীতে আমরা ১০জন রেকি করতে বের হই। আগে থেকে আমরা বুঝতে পারিনি যে পাকসেনারা এ্যামবুশ করে আছে। আমরা এ্যামবুশে পড়ে যাই। শামসুল আলম নামক একজন ইপিআর ওখানে শহীদ হন। বাকী নয়জন কোন রকমে বেঁচে আসি। সময় ছিল রাত সাড়ে দশটা। ৩১শে মার্চ সেকেণ্ড ক্যাপিটালে আসাদ গেটের নিকটে হাসপাতালের কাছে পাক সেনাদের অবস্থান ছিল। আমরা রাত ৩টায় আক্রমণ চালাই। এতে ৫জন পাক সেনা খতম হয়। আমাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

 ভোর পাঁচটায় পাকসেনারা ব্যাপক সেনা ও অস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। ওদের সামনে টিকতে না পেরে পালাবার চেষ্টা করি। সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, বেশ কিছু শহীদ হন। আমিসহ সাতজন পাক সেনাদের হতে ধরা পড়ি। তারিখ ছিল ১লা এপ্রিল।

বংশাল ফাঁড়ির প্রতিরোধ[১]

 ১৯৭১সালের পঁচিশে মার্চের সেই ভয়ংকরী রাত্রি, যার কথা বাংলাদেশের মানুষেরা কোনো দিনই ভুলতে পারবে না। ওরা ঢাকা শহরকে রক্তবন্যায় ভাসিয়ে দেবার জন্য অতর্কিতে নেমে এলো। ওরা জানতো, এদেশে ওদের পক্ষে কেউ নেই। সরকারী কর্মচারী থেকে রাস্তার পুলিশ পর্যন্ত, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী থেকে শহরের


  1. শারদীয় কালান্তর, সেপ্টেম্বও ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত সত্যেন সেন রচিত “নাদির গুণ্ডা” শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।