পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৩

একটিমাত্র লোক আছে যার হাতে একটি মেশিনগান আছে। সেই লোকটি হচ্ছে নাদির গুণ্ডা নামে পরিচিত নাদির মিঞা। কি করে সে এই মেশিনগান সংগ্রহ করেছিল, একমাত্র সে-ই জানে।

 প্রাক-স্বাধীনতার যুগে বিখ্যাত উর্দু লেখক কিষণচন্দর ‘তিন গুণ্ডা’ নামে এক অপূর্ব কাহিনী লিখেছিলেন। কাহিনীর সেই তথাকথিত গুণ্ডারা স্বাধীনতা আন্দোলন উপলক্ষে গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল। কিন্তু সত্য সত্যই এরা কেউ গুণ্ডা ছিল না। সরকারী প্রচারণায় স্বাধীনতা আন্দোলনের এই শহীদদের গুণ্ডা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।

 নাদির গুণ্ডার ব্যাপারটা কিন্তু সে রকম নয়। সত্য সত্যই সে গুণ্ডামি করত। যেই পরিবেশে জন্মেছিল, বড় হয়েছিল, সেই পরিবেশই তাকে এই পথে টেনে আনে। বয়স আর কত? ত্রিশের কোঠার নিচেই ছিল। এই বয়সেই সে গুণ্ডা নামে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। তবু সাধারণ গুণ্ডাদের চেয়ে সে স্বতন্ত্র ছিল। তার পরিচিত যারা, এর কথাটা তাদের জানা ছিল যে, অনেকে বিপদে-আপদে নাদির গুণ্ডার কাছ থেকে নানাভাবে সাহায্য পেয়েছে, ভালোবাসাও পেয়েছে।

 এই সংসারে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা বিশ্বাস করা কঠিন অথচ সত্য। নাদির গুণ্ডার জীবনে এমনি এক ঘটনা ঘটল। স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের সংস্পর্শে এসে লোকটা কেমন করে যেন সম্পূর্ণ বদলে গেল। আর সব কথা যেন ভুলে গেল সে। কেমন করে বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রের হাত থেকে মুক্ত করা যাবে- এটাই তার ধ্যান, জ্ঞান, জপমন্ত্র হয়ে দাঁড়াল। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না হলেও সে বিভিন্ন মহল্লায় রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলত।

 একটা বিষয়ে সে নিঃসন্দেহে ছিল যে, সত্য সত্যই ওদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে হবে। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সে এই মেশিনগান আর অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়েছিল। আর এই নাদির গুণ্ডার প্রভাবে একই পথের পথিক আরও কয়েকটি ছেলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল।

 পঁচিশে মার্চের সেই বিভীষিকা নাদিরের মনকে বিন্দুমাত্র দমিয়ে দিতে পারেনি। ওদের সেই পৈশাচিক হত্যা আর ধ্বংসলীলা তাকে প্রতিহিংসায় উন্মত্ত করে তুলেছিল। সারা শহরে হতাশা আর আতঙ্কের আবহাওয়া। তার মধ্যে দুর্জয় সাহস বুকে নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে সে প্রতিরোধের কৌশল ও সংগঠন গড়ে তুলেছিল। তার এই সাহস আর নিষ্ঠার পরিচয় পেয়ে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে মহল্লার লোকেরা তাকে আপন মানুষ বলে চিনে নিল।

 তারা বলাবলি করত, এই শহরে নাদিরের মতো আরও গোটা কয়েক মানুষ যদি থাকত, তবে আমরা ওদের নাভিশ্বাস তুলে দিতে পারতাম। নাদিরের নামটা মিলিটারি গোয়েন্দাদের কাছে পৌঁছতে দেরি হয়নি। তারা তন্নতন্ন করে তার সন্ধান করে ফিরছিল।

 পঁচিশে মার্চের পর থেকেই লুণ্ঠনরত সৈন্যের দল ঘরবাড়ি-দোকানপাট ভেঙ্গেচুরে ইচ্ছামতো লুঠপাট করে চলেছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শহরের গোটা কয়েক রেশনের দোকান লুট হয়ে গেল। শহরের মানুষ ভয়ে আঁতকে উঠল। এভাবে রেশনের দোকান যদি লুট হয়ে যায়, তবে খাবে কি তারা? শেষকালে কি না খেয়েই মরতে হবে? ভয়ে দিশেহারা মানুষ কি করবে পথ খুঁজে পায় না।

 রেশন দোকানের মালিকেরা ভয়ে দোকান খুলতে চায় না। এই দুর্দিনে সর্বসাধারণের অবস্থা চিন্তা করে অস্থির হয়ে উঠল নাদির। কিছু একটা করতেই হয়। ঐ শয়তানেরা এসে রেশনের চাল লুট করে নিয়ে যাবে আর তারা অসহায়ের মতো হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখবে, এ কিছুতেই চলবে না। কিন্তু কি করতে পারে সে?