পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৫৫

 বাহিনীর ঊর্ধ্বতন সদর দফতর ‘মহানন্দপুরে অবস্থিত ছিল। বাহিনীর একজন প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন। একাত্তর সালের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশে সরকারের অনুমতিক্রমে কাদের বাহিনীর জনগনের দৈনন্দিন জীবনের সকল দুঃখ-দুর্দশা মোচনের জন্যে সামগ্রিক ব্যবস্থা গ্রহন শুরু করেন।

 কাদের বাহিনীর একটি সিকিউরিটি বা ইনটেলিজেন্স বিভাগ এবং সাথে সাথে কাউণ্টার ইনটেলিজেন্স ব্যবস্থা চালু ছিল। বাহিনীর লোকজন সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ করে রিপোর্ট করা ছিল এদের কাজ। মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি ছিল কাঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। কাদের বাহিনীর সিগন্যাল বা কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবস্থা ছিল অদ্ভুত। সর্বক্ষণ বিভিন্ন এলাকায় রুটিনমাফিক সিগন্যালম্যানের কাছে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে খবর পৌঁছে দিতো। সে পৌঁছে দিতো পরের পয়েণ্টে। এমনি করে করা হতো খবর এবং তা সব সময়ই (বিশেষ করে যা জরুরী গোপন আশু নির্দেশ) থাকতো লিখিত। বিভিন্ন পয়েণ্টের সিগন্যালম্যানের নাম তাতে স্বাক্ষরিত থাকতো। কাদের সিদ্দিকী জানান যে, এভাবে ১০ মাইল দূরবর্তী কোন স্থান খবর পাঠাতে তাদের সময় লাগতো বড়জোর ২৫ মিনিট। নভেম্বর মাস থেকে কাদের বাহিনীর শক্তিসম্পন্ন বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করে।

॥ যুদ্ধে কখনো হারিনী-কিন্তু নাগপুরের কোন যুদ্ধে আমি জিতিনিঃ কাদের সিদ্দিকী ॥

 কাদের বাহিনীর মোট লড়াইয়ের সংখ্যা তিনশরও বেশী। প্রত্যেকটি যুদ্ধ হামলা কিংবা স্যাবোটাজ অপারেশনই ছিল কোন না কোন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তবুও এর মধ্যে কয়েকটি লড়াই-এর স্মৃতি মনে দাগ কেটে রয়েছে। সে কথাই বলছিলেন কাদের সিদ্দিকী। ১১ই আগষ্ট কমাণ্ডার হাবিবের নেতৃত্বে কাদের বাহিনী একটি দল ভূয়াপুরের কাছে মাটিকাটায় ধলেশ্বরীতে পাকবাহিনীর অস্ত্রবাহী জাহাজের ওপর হামলা চালাল। জাহাজটির নাম আর এস ইউ ইঞ্জিনিয়ার্স, এলসি-৩। ঢাকা থেকে রংপুরের সেনানিবাসে যাচ্ছিল ২১ কোটি টাকার অস্ত্র নিয়ে। সঙ্গে আরও কয়েকটি জাহাজ ছিল। কিন্তু কাদের বাহিনীর যোদ্ধারা সিরাজকান্দির উত্তরে মাটিকাটা চরে নদী তীরবর্তী দুটি বাড়ি থেকে স্টেনগান, এলএমজি আর মর্টার দিয়ে হামলা চালিয়েছিল সঠিক লক্ষ্যবস্তুর উপর। ঘায়েল হলো জাহাজ, কুপোকাত হলো জাহাজের অধিনায়ক আমানুল্লাহ খান, খতম হলো শতাধিক খান সেনা। কাদের বাহিনী ছিনিয়ে নিল ২১ কোটি টাকার অস্ত্র ও গোলাবারুদ যার মধ্যে ছিল ১২০ এম এম ২ ইঞ্চি ও ৩ ইঞ্চি মর্টার, ৮৩ এম এম ক্যালেণ্ডার সাইজ ভারী কামান ও প্রচুর রাইফেল। এরপর পাক বাহিনী প্রচণ্ড আক্রোশে পাল্টা হামলা চালিয়েছিল। দুটো এফ-৮৬ স্যাবর জেট তাদেরকে কভার দিকে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু কিছুই হয়নি। ২১ কোটি টাকার অস্ত্র কাদের বাহিনী তাদের সদর দফতর নিয়ে চলে গেল। এই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে কাদের সিদ্দিকীও মাটিকাটায় ছিলেন।

 ব্যক্তিগতভাবে যে সব যুদ্ধ করেছেন তার মধ্যে মনে দাগ কাটবার মতো কয়েকটি যুদ্ধের কথা কাদের সিদ্দিকী বললেন। একটি যুদ্ধ হল আগষ্টে ধলাপাড়ার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী আহত হন। ২০শে নভেম্বর আড়াই হাজার পাকসেনা অর্থ্যাৎ পুরো একটি বিগ্রেডকে ঢাকা-টাঙ্গাইল রোড থেকে হাটিয়ে দিয়ে করটিয়া পর্যন্ত এলাকা কব্জায় রেখে ২৩ ঘণ্টায় ১৭টি সেতু ধ্বংস করে দেয় কাদের বাহিনী। পাক বাহিনী পাল্টা বিমান আক্রমণ চালায় কাদের সিদ্দিকী জানান, এত সামনাসামনি যুদ্ধ এর আগে আমি কোনদিন করিনি। ওরা একবার এগিয়ে আসছে, আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। আবার আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ওরা পিছু হটছে। এভাবে পাঁচ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর পাক সেনারা হেরে যায়। কাদের বাহিনী পাকসেনাদের কয়েক মাইল পিছু হটিয়ে দিয়ে আসে।

 কাদের সিদ্দিকীর ব্যক্তিগত অংশগ্রহন-সমৃদ্ধ যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে ধকল গেছে নাগপুরের যুদ্ধে। কাদের সিদ্দিকী আমাকে বললেন, আমার জন্য টাঙ্গাইল জেলায় একটি দুর্ভাগ্যজনক থানা ছিল নাগরপুর। আমি