পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৫৭

ডিসেম্বর কাদের সিদ্দিকী মার্চ শুরু করলেন। তখন কামালপুরে সম্মিলিত বাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর যুদ্ধ চলছে। কাদের সিদ্দিকী স্থির করলেন তিনি মধুপুর দখল করে পুংলী সেতু পর্যন্ত আসবেন।

 কাদের সিদ্দিকী বললেন, ৭ই ডিসেম্বর আমি নিকরাইল থেকে কোথায় কি করা হবে তার পরিকল্পনা করলাম। স্থির করলাম আমার ৫হাজার যোদ্ধাকে নিয়ে এবারকার পরবর্তী পর্যায়ের অপারেশন চালাবো। আর সব যোদ্ধা থাকবে ডিফেন্সে এবং এই ৫হাজার করবে এ্যাকশন। এর আগে ৬ই ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃত দিয়েছে। ৭ই ডিসেম্বর আমি নিকরাইলে জনসভা করলাম। কুড়ি থেকে ত্রিশ হাজার লোক হল। সভায় জনগণকে বললাম, আপনাদের সাথে আর দেখা হবে কিনা জানি না। বাংলাদেশ আজ স্বীকৃতি পেয়েছে। কাদের সিদ্দিকী বললেন, ৭ই ডিসেম্বর রাতে সম্মিলিত বাহিনীতে ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সানত সিং আমাকে অয়ারলেসে যোগাযোগ করে জানালেন, আমরা জামালপুর পর্যন্ত এসে গেছি, ব্রহ্মপুত্র নদী আমরা পার হতে পারছি না। আপনি জামালপুরের দক্ষিণ দিক থেকে পাকবাহিনীর উপর হামলা করুন আর আমরা উত্তর দিকে থেকে হামলা করছি। আমি তাই জামালপুর রওয়ানা হলাম। কিন্তু ধনবাড়ী পর্যন্ত গিয়ে মত পরিবর্তন করলাম। আমি ঘুরে পথ পরিবর্তন করলাম। ৯ই ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার সানত সিংকে অয়ারলেসে জানালামঃ আমি আপনার প্রস্তাবে মানতে পারলাম না। কিন্তু ঢাকা থেকে পাকবাহিনী যেন ফোর্স পাঠাতে না পারে আমি সেই চেষ্টা করছি। আমি কথা দিলাম, পাক বাহিনীর একটি সৈন্যও যদি এই পথে এইদিকে আসতে পারে তবে আমি আইনত দণ্ড নেবো। আপনি আমাদের একটু উপকার করুন- গোপালপুরে আমাদের একটু এয়ার কভার দিন।

 কাদের সিদ্দিকী বললেন, তাঁরা আমাদের কথায় রাজী হলেন। ১০ই ডিসেম্বর সকাল বেলা আমরা ঘাটাইল থানার হামলা করলাম। বিকেল সাড়ে চারটায় থানা ঘাঁটির উপর হামলা করলাম। সেদিনই ঘাটাইলের পতন হলো। এদিকে সকাল ১০টা-১১টায় গোপালপুরে এয়ার কভার দেওয়ার কথা, আমার বাহিনীর যোদ্ধারা সেখানে অপেক্ষা করছে। কিন্তু বিমানের দেখা নেই। আমাদের কোন কনর্ফামও করেনি। আমার ছেলেরা গোপালপুর ঘাঁটিতে আক্রমন চালিয়ে কব্জা করে নিতে পারে। কিন্তু তারা বিমান হামলার জন্য অপেক্ষা করছে। পরে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গ গেল। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আমার ছেলেরা শত্রুরা ঘাঁটির উপর আক্রমন করলো। পতন হলো গোপালপুরের।

 বলছিলেন কাদের সিদ্দিকীঃ এদিকে জামালপুরে আর আমাদের সাহায্যের দরকার হয়নি সম্মিলিত বাহিনীর। জামালপুরে শত্রু অবস্থানের উপর সম্মিলিত বাহিনীর বিমান এক হাজার পাউণ্ডের দুটি বোমাবর্ষণ করে। এতে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে শত্রুদের প্রায় ৩৮টি মরিচা ধসে একেবারে পুকুরের মতো হয়ে যায়। এরপর পাকবাহিনী পালাতে শুরু করে। এদিকে রাস্তাটি এলাংগা পর্যন্ত আমাদের দখলে এসেছে। টাঙ্গাইলে পাকবাহিনীর রয়েছে। পলাতক পাকবাহিনীর কনভয়ের উপর সম্মিলিত বাহিনীর বিমান স্ট্রাফিং করে গেল। ১১ ডিসেম্বর ভোর বেলায় আমরা পরিকল্পনা নিলাম আজ টাঙ্গাইল দখল করতেই হবে। কমাণ্ডার হাবিবের নেতৃত্বে একটি বাহিনীকে পাঠানো হলো ময়মনসিংহ থেকে পাকবাহিনী আগমনকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য। আগের রাতেই খবর পেয়েছি পাকবাহিনীর কনভয় যেতে পারছেনা। টাঙ্গাইল-ঢাকা রোডে পাতা আমাদের মাইনের জালের ফাঁদে তারা আটকা পড়েছে। প্রত্যেকটি সেতুর নিচের ডাইভারসন রোডে রয়েছে মাইন। ভাতকুড়া ব্রীজের নীচে একটি মাইনের ঘায়েই পড়ে গেলো এগারোটি গাড়ি। রোড় ক্লিয়ার নেই। টাঙ্গাইল থেকে ভাতকুড়া হয়ে কালিহাতি পর্যন্ত লাইনআপ হয়ে রয়েছে শত্রুদের কনভয়ের গাড়ী। কালিহাতী থানা আমাদের ছেলেদের দখলে। আমরা এগিয়ে এলাম। আমি ১১ই ডিসেম্বর আবার সম্মিলিত বাহিনীর বিমানকে টাঙ্গাইল থেকে এলাঙ্গা পর্যন্ত বিমান হামলা ও এয়ার কভারের কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন, দিচ্ছেন। এদিকে কমাণ্ডার সবুরকে রেকি পার্টি নিয়ে পাঠিয়েছি। কিন্তু তারা এগিয়ে গেছে। ভয় হলো বিমান হামলা না আবার ভুলে তার উপর হয়। আল্লাহর রহমত, এলাঙ্গা থেকে অল্প একটু এ পাশে সবুর হল্ট হরেছে। হল্ট এ জন্য করেছে যে ওপাশে পাকবাহিনী রয়েছে এক ব্যাটালিয়ন। আটকা পড়েছে। সবুরকে নির্দেশ দিলাম একটু পিছিয়ে আসার জন্য। এর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বিমান হামলা হলো। সে কি মার! পাকবাহিনীর সেখানে পালিয়েছে সেখানেই তার ওপর হামলা। শত্রুরা দিশেহারা