পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৫৮

হয়ে পড়লো। অমরা ডবল মার্চ করে এগিয়ে গেলাম। আমাদের দেখে পাকবাহিনীর সেকি দৌড়। পাকবাহিনী যে এমন দৌড়াতে পারে তা না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। আমরা তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপই করলাম না। ধরাতো ওরা পড়বেই। আমদের বাহিনী সড়ক ধরে এগিয়ে চললো। আমাদের বাহিনীর তারপর পুংলী ব্রীজে পৌঁছলো। সে সময় ওখানে ভারতীয় বাহিনীর ছাত্রীসৈন্য নামল। অনেক এলাকা জুড়ে তারা নামলো। একটু পরে খবর আসলো ভারতীয় বাহিনী এসে পড়েছে। আমি ভাবতে পারিনি এত তারাতাড়ি তারা আসতে পারবে। আমকে তারা জিজ্ঞাসা করলেন টাঙ্গাইলের খবর কি? আমি বললাম, টাঙ্গাইলের দায়িত্ব তো আমার। একটু সবুর করুন। খানিক পর খবর দিচ্ছি। পাকবাহিনীর ফেলে আসা বাসে উঠলাম। এসে দেখি গোলাগুলি চলছে শহরে। পাকবাহিনীর তিনশ সৈন্য রয়েছে শহরে। আমার বাহিনীর যোদ্ধাদের সঙ্গে পাল্লা গুলি বিনিময় হচ্ছে। কিন্তু আত্মসমর্পন করছে না। বলছে যে, হয় ভারতীয় বাহিনী, নায়তো কাদের বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। আমি গিয়ে আহববান জানালাম অত্মসমর্পণের জন্যে। পাকবাহিনীর কমাণ্ডার এসে আত্মসমর্পণ করে বললোম ‘যো আপ করে।' ভারতীয় বাহিনীর কাছে খবর গেল, এবার আসতে পারেন। টাঙ্গাইল ক্লিয়ার। অবশ্য টাঙ্গাইল সকালেই ক্লিয়ার হয়েছিল। আমার শুধু অন্য সব দায়িত্ব আটক থাকায় আসতে দেরি হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী টাঙ্গাইল এলো। গোড়াই পর্যন্ত আমি অপারেশন প্লান করে দিয়েছিলাম। খবর পেলাম গোড়াই পর্যন্ত সব ক্লিয়ার।

॥ আমার পরিচয় পেয়ে নিয়াজী তড়াক করে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করলো ॥

 ১২ই ডিসেম্বর। গোরাই গিয়ে অবস্থান নিল ভারতীয় বাহিনী। কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনীকে ১২ ও ১৩ই ডিসেম্বর বিশ্রামের নির্দেশ দিলেন। ১৪ ডিসেম্বর তিনি টাঙ্গাইলে জনসভা করলেন। সেই জনসভায় বললেন ভাইসব, এই বোধ হয় শেষ দেখা। আর দেখা নাও হতে পারে। এই যে আপনাদের সাথে মিলিত হতে পারলাম এটাই আমার শান্তি। কাদের সিদ্দিকী আমাকে এ প্রসঙ্গে বললেন, ঢাকা যে এত সকালে মুক্ত হবে তখনো তা ভাবিনি। আমি মনে করেছিলাম অন্তত আরো একমাস যুদ্ধ হবে। কাদের সিদ্দিকী ঢাকা অভিযানের জন্য নিজের বাহিনী থেকে আড়াই হাজার যোদ্ধা বাছাই করলেন। শুরু হলো ঢাকা অভিমুখে অভিযান। স্থির হলো দুটি পথে সম্মিলিত বাহিনী ঢাকার দিকে এগিয়ে যাবে- ১। সাভার হয়ে এবং ২। টঙ্গী হয়ে।

 ১৫ই ডিসেম্বর সকালে পাকবাহিনী সম্মিলিত বাহিনীর অগ্রাভিযান রোধ করার জন্য কড়ার সেতু ভেঙ্গে দেয়। এসব ঘটনার কথা বলছিলেন কাদের সিদ্দিকী, ‘সকালে ওরা ব্রিজ উড়িয়ে দিল। সম্মিলিত বাহিনীতে ভারতীয় বাহিনীর মেজর জেনারেল নাগরা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেয়া সিদ্দিকী! কেয়া হো গোয়া! আমি বললাম, কি আর হবে। পাক বাহিনী ব্রিজ ভেঙ্গে দিল। পাকবাহিনীর কাণ্ড দেখে আমার তখন খুব হাসি পাচ্ছিল। ভাবছিলাম, পাক মিলিটারি তোদের রোধ করার জন্য ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলি। মেজর জেনারেল নাগরাকে বললাম, আজ আভি অর নেহী যায়েগা। জেনারেল নাগরা বললেন, কিউ সিদ্দিকী কিউ? আমি বললাম, হাম প্লান বানায়েঙ্গে। রাতের বেলা পরিকল্পনা তৈরি করলাম। একদল ডানদিকে আর এক দল বাম দিকে রাতের আরছায়ার নদী পার হলো স্থানীয় লোকজনের সহায়তায়। আমাদের ১০০ জন করে মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনীর একটি করে ব্যাটালিয়ান। পাক বাহিনী তখনো নিশ্চিন্তে রয়েছে। ভেবেছে, আমরা তো নদী পার হতে পারবোই না। আল্লাহর কি রহমত, সম্মিলিত বাহিনী নদী পার হয়েই শত্রুদের দুজনকে মেরে ফেললো। ব্রিজ ভেঙ্গে যারা খেতে বসেছিল তাদের পাকড়াও করলো।

 ১৫ই ডিসেম্বর সকালে সম্মিলিত বাহিনীর আরেকটি দল এগিয়ে গিয়েছিল সাভারের পথে। এখন যেখানে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প সেখানে যুদ্ধ হয়। তারপর আর কোন যুদ্ধ হয়নি। এই বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর সকালে মিরপুর থেকে সাভার অভিমুখী সড়ক সেখানে প্রস্থে দ্বিগুণ হয়ে অর্থাৎ ডবল রোড হিসেবে শুরু হয়েছে সেখানে এসে অবস্থান নিল। আর এদিকে টঙ্গী অভিমুখী বাহিনী ১৬ ই ডিসেম্বর বোট বাজারে এসে পৌঁছলো।