পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৬১

  এ সব কোম্পানী ছাড়া রেজাউল কোম্পানী, হুমায়ন কোম্পানী, বেনু কোম্পানী, আমানুল্লাহ কোম্পানী প্রভুতি ছোট ছোট মুক্তিসেনা দল এই অঞ্চলে অভিযান চালাতো।

  ‘৭১ সালের ৭ই জুলাইয়ের মধ্যে মুক্তাঞ্চলের চারিদিকে এই দুর্ভেদ্য ঘাঁটি স্থাপন শেষ হলো। বাঘা সিদ্দিকী প্রতিদিন এক ঘাঁটি থেকে অন্য ঘাঁটিতে ঘুরে ঘরে বীর সৈনিকদের নিয়ম শৃঙ্খলা ও কর্তব্য নিষ্ঠা পরীক্ষা করে ফিরতে লাগলেন। তার সঙ্গে রাখলেন ৩০/৩৫ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। এঁরা রণকৌশল অতি নিপুণভাবে আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। যখনই কোন অঞ্চলে যুদ্ধ লেগেছে, এই দল উল্কার মতো ছুটে গিয়েছে এবং যুদ্ধরত স্থানীয় সেনাদের কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। সেজন্য বাঘা সিদ্দিকী এই দলটিকে বলা হতো ফাইটিং প্লাটুন বা লডুয়ে দল।

  গ্রেডে পার্টি বা সুসাইড স্কোয়াড: মুক্তিযুদ্ধে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহন করে গ্রেনেড বা হাতবোমা নিক্ষেপকারীর দল। এরা হানাদার সেনাদের আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কদেরিয়া বাহিনীতে এই রকম গ্রেনেড নিক্ষেপকারীদের শক্তিশালী দল গড়ে তোলা হয়। এদের বলা হত সুসাইড স্কোয়াড যাকে যুদ্ধের পরিভাষায় বলা হয় জানবাজ। জীবনকে বাজি রেখে এরা জীবনের সন্ধান দেয়। এই শাখায় যারা বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছেন তাঁদের মধ্যে বাকু সালাহউদ্দিন (শহীদ), আবুল কালাম ও মিনুর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

  সদর দফতর: মুক্তিবাহিনীর হেড কোয়ার্টার বা সদর দফতরের অবস্থান ও কার্যপ্রণালী বিবৃত করা প্রয়োজন। শালগজারী আবৃত গভীর জঙ্গলের মধ্যে এই সদর দফতর স্থাপন করা হয়। এই দফতরটির পাঁচটি বিভাগ, যথা- (১) অস্ত্রাগার (২) বেসামরিক দফতর (৩) বেতার যোগাযোগ ও টেলিফোন (8) হাসপাতাল ও (৫) জেলখানা। সদর দফতরের আবাসিক অধিনায়ক হলেন আনোয়ারুল আলম শহীদ। অস্ত্রাগার বেতার যোগাযোগ ও টেলিফোন দফতরটি কড়া প্রহরাধীনে রাখা হয়। এগুলির নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কঠোর। স্বয়ং অধিনায়ক সিদ্দিকীর অনুমোদন ব্যতীত অন্য কারো এই দফতরে প্রবেশের অধিকার ছিল না। গভীর জঙ্গলের মধ্যে এক মাইল এলাকা জুড়ে এই সব দফতর স্থাপন করা হয়। প্রত্যেকটি বিভাগই টেলিফোন দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত করা হয়।

  সদর দফতরের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ট্রেনিং ক্যাম্প বা শিক্ষা শিবির ও ট্রানজিট ক্যাম্প। ট্রেনিং ক্যাম্পটি খোলা হয় সখীপুর থেকে দুই মাইল উত্তরে আন্দি নামক স্থানে। এই স্থানটিও ছিল গভীর জঙ্গলের মধ্যে। তিন একর পরিমাণ জমির উপর টিনের ছাপড়া ঘর তুলে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। জঙ্গল গাছপালার ডালপাতা টিনের ছাদের উপর স্বাভাবিক আচ্ছাদন সৃষ্টি করেছিল। ফলে পৃথক ছদ্মাবরণের প্রয়োজন হয়নি। দুশমনের বিমান কখনো এই অঞ্চলের সন্ধান পায়নি। শিবির এলাকায় কূপ খনন করে পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়। সর্বাধিক সিদ্দিকীর অনুপস্থিতিতে রিক্রুটিং অফিসার খোরশেদ আলম নতুন লোক ভর্তি করতেন। রেশন সরবরাহের দায়িত্ব তাঁর উপর দেওয়া হয়। সদর দফতরের পাঁচ বর্গামাইল এলাকা বাঘা সিদ্দিকীর নির্দেশে সংরক্ষিত এলাকা বলে গণ্য হতো।

  বেসামরিক দফতর: এই দফতরের অধিনায়ক আনোয়ারুল আলম শহীদ তাঁর দফতর স্থাপন করেন মহানন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন। সংরক্ষিত এলাকার বাইরে এই দফতর স্থাপন করার কারণ হলো, জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগের রক্ষা করা। এটাই এদের অন্যতম কর্তব্য। সংরক্ষিত এলাকায় থেকে এটা সম্ভব নয়। শহীদ সাহেব তার দফতরের কাজ ভাগ করে কয়েকজনের উপর ন্যস্ত করেন। অর্থ ও হিসাব বিভাগের ভার পেলেন আনোয়ার হোসেন। ইনি বেঙ্গল রেজিমেণ্টের নন কমিশনড অফিসার ছিলেন। হিসেব সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রচুর অভিজ্ঞতার অধিকারী এই হোসেন সাহেব অতি দক্ষতার সঙ্গে অর্থ সংরক্ষণ ও ব্যয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব রক্ষার দাযিত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের জন্য সাহায্য ও দালালদের জরিমানার মাধ্যমে যে অর্থ পাওয়া যেত তার সবটাই প্রথমে সদর দফতরে পাঠানো হতো। বাঘা সিদ্দিকীর অনুমোদনক্রমে এই অর্থই পরে বিভিন্ন