পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৪

 একদিন মহল্লার লোকেরা অবাক হয়ে দেখল নাদির আর তার দলবল তাদের রেশনের দোকান ভেঙ্গে বস্তা বস্তা চাল বের করে নিয়ে যাচ্ছে। শেষকালে নাদিরের এই কাজ! তারা হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কিন্তু একটু পরেই তাদের আসল ব্যাপারটা বুঝতে বাকি রইল না। নাদির তাদের মুখের দিকে চেয়েই এই দুঃসাহসের কাজে হাত দিয়েছে। নাদির আর তার সঙ্গীরা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সেই চাল মহল্লার ঘরে ঘরে ভাগ করে দিল। পাড়ার লোকে তখনকার মত কিছুটা চাল পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। হাতের কাজটা সেরে ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেল নাদির। তার মাথার উপর মৃত্যুর পরোয়ানা ঝুলছে। খবরটা ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। মিলিটারির জীপ তার সন্ধান নিয়ে ফিরছে।

 এরপর দুঃসাহসী নাদির আর বেশীদিন কাজ করার সুযোগ পায়নি। এপ্রিলের মধ্যভাগে গ্যাদা নামে এক কুখ্যাত গুল্ডা তাকে মিলিটারির হাতে ধরিয়ে দিল। গ্যাদা ইতিমধ্যেই মিলিটারীর দালালি করে আরো কয়েকজনকে ধরিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া নাদিরের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল। একবার নাদিরের গুলিতে জখম হয়ে তাকে বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল। তখন রাত অনেক হয়েছে। নাদির একটি জীপে করে আসছিল। আর্মানিটোলা ময়দানের কাছে এসে তার জীপটা একটা বাড়ির পাশে দাঁড়াল। ওরা আগে থেকেই তৈরী হয়ে ছিল। একটা সঙ্কেত পেয়ে মিলিটারীর লোকের বিদ্যুতগতিতে এসে তার জীপটাকে ঘিরে ফেলল। তারপর তারা তাকে ধরে নিয়ে তাদের আস্তানায় চলে গেল। নাদির সেই যে গেল, তারপর আর ফিরে আসেনি। ফিরে আসবে না কোনদিন।

নরসিংদীতে সশস্ত্র প্রতিরোধ[১]

 এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহ।

 ভারতীয় বেতার মারফৎ একটি সংবাদ প্রচারিত হলো- ঢাকা শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে কোন এক জায়গায় পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ চলছে। খবরটা চাঞ্চল্যকর, বিশেষ করে ঢাকা জেলার লোকদের কাছে। দিনের পর দিন বাংলাদেশের নানা জায়গা থেকে মুক্তিবাহিনীর সক্রিয়তার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ঢাকা জেলায় তাদের প্রতিরোধের চিহ্নমাত্র নেই। অবশ্য ২৫শে মার্চ তারিখে সামরিক হামলার প্রথম রাত্রিতে রাজারবাগের পুলিশ ভাইয়েরা বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ দিয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এই কাহিনী অবিস্মরণীয়। তার দুই দিন বাদে নারায়ণগঞ্জ শহরের সংগ্রামী ভাইয়েরা শুধুমাত্র গোটা কয়েক রাইফেলের উপর নির্ভর করে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় সুশিক্ষিত সৈন্যদলকে দুই দিন পর্যন্ত আটকে রেখেছিল শহরে ঢুকতে দেয়নি। তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে উদ্যোগী ভূমিক গ্রহণ করেছিল তারা সবাই তরুণ ও কিশোর; অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে একেবারেই কাঁচা। আমাদের এই সংগ্রামী ভাইদের জন্য ঢাকা জেলার মানুষ সঙ্গতভাবে গর্ববোধ করতে পারে। কিন্তু তারপর?

 তারপর থেকে সারা ঢাকা জেলায় মুক্তিসংগ্রামীদের কোন সাড়া শব্দ নেই। ঢাকা জেলার মানুষ দুঃখ করে বলে, সবাই এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাই শুধু পেছনে পড়ে আছি।

 কুড়ি কিলোমিটার দূরের সেই জায়গাটা কোথায় তাই নিয়ে বিতর্ক ও বাদানুবাদ চলে। দূরত্ব সম্পর্কে অনেকের সঠিক ধারণা নেই। কেউ বলে সাভার,

 কেউ বলে নরসিংদী, আবার কেউ বলে জয়দেবপুর। আবার এমন লোকও আছে যারা এই ভারতীয় প্রচারণাকে একদম গাঁজাখোরি বলে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ একে সত্যি বলে বিশ্বস করে। শুধু যে


  1. সত্যেন সেন রচিত ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ (আগষ্ট ১৯৭১) নামক গ্রন্থের “ওরা বারো জন” শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে সংকলিত।