পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৫

বিশ্বাস করে তাই নয়, নিজেদের কল্পনার সাহায্যে তাদের আরো দ্বিগুণ করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলে। ইতিপূর্বে নরসিংদীর উপর পাকিস্তানী বোমারু বিমান বোমা ফেলেছে। এটা ভারতীয় বেতারের প্রচার নয়, প্রত্যক্ষদর্শীরা বোমাবিধ্বস্ত নরসিংদীর সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে এসেছে।

 বাইরের লোকে এটুকুই শুধু জানল, কিন্তু ঠিক কোন জায়গায় যুদ্ধ বেধেছিল এবং যুদ্ধের ফলাফল কি সেই সম্পর্কে কারো মনে কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তাছাড়া নিত্যনতুন এমন সব চমকপ্রদ ঘটনা ঘটছে যে শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দুরের সেই সংঘর্ষ সম্পর্কে কে আর মাথা ঘামায়।

 যারা বাইরের লোক তাদের কাছে ঘটনাটা ছোট হতে পারে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে ঘটনাটা দারুণ উত্তেজনা ও উৎসাহের সৃষ্টি করেছে। আমার এক বন্ধু তার নিজস্ব কাজে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিল, সেইজন্যই এই উল্লেযোগ্য ঘটনাটা সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে পারছি। আজ সারা বাংলাদেশ জুড়ে এই ধরনের যে সমস্ত ঘটে চলেছে, তার কতটুকু খবরই বা আমরা রাখি।

 পাকিস্তানের বোমারু বিমান ৪ঠা এপ্রিল ও ৫ই এপ্রিল পরপর দুই দিন নরসিংদীর উপর বোমা ফেলেছিল। তারপর দিন সাতেক কেটে গেল, ইতিমধ্যে পাকিস্তানী সৈন্য বা মুক্তিবাহিনী কেউ নরসিংদীতে প্রবেশ করেনি। তারপর হঠাৎ একদিন শোনা গেল পাকিস্তানী সৈন্যরা নরসিংদী দখল করবার জন্য ছুটে আসছে। গুজব নয়, প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদের দেখে এসেছে।

 তাঁতের কাপড়ের হাট হিসেবে বিখ্যাত বাবুরহাট থেকে জিনারদী পর্যন্ত একটি রাস্তা চলে এসেছে। মাইল সাতেকের পথ, জিনারদী থেকে নরসিংদী তিন মাইল। সৈন্যরা এই পথ ধরে এগিয়ে আসছিল। তাদের দলে কয়েকশ’ সৈন্য। সৈন্যবাহিনীর ট্রাকগুলি একের পর এক মিছিল করে আসছিল। তাদের সঙ্গে মর্টার, রকেট, মেশিনগান- কোন কিছুরই আভাব নেই। মুক্তিবাহিনীর ‘দুষ্কৃতকারী’ লোকগুলিকে তারা নিঃশেষে খতম করবে, চূর্ণ করে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে।

 বাবুরহাট থেকে জিনারদী, মাঝখানে পাঁচদোনা গ্রাম। এই পাঁচদোনা গ্রামের কাছে সংঘর্ষটা ঘটেছিল, সেইদিন ১৩ই এপ্রিল। প্রথমে গোটা পাঁচেক সৈন্যবাহী ট্রাক। এই ট্রাকের কনভয় থেকে সৈন্যরা কিছুটা সামনে এগিয়ে এসেছে। পথ জনশূন্য। তবে মাঝে মাঝে দুটি-একটি অতি সাহসী কৌতূহলী লোক ঝোপ-ঝাড়ের আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে। সৈন্যরা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চলেছিল। হঠাৎ এক সময় শান্ত পল্লী- প্রকৃতিকে চমকে দিয়ে গুডুম গুড়ুম পরপর তিনবার কামানের গর্জন শোনা গেল। অতি পরিচিত মর্টারের আওয়াজ। শুধু আওয়াজই নয়, একটা গোলার টুকরো ছিটকে এসে একটা ট্রাকের উপর পড়ল। ট্রাকের উপর সৈন্যদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এমন অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রান্ত হতে হবে এটা ওরা ভাবতে পারেনি। ওরা কি তার শত্রুপক্ষের কব্জির মধ্যে এসে পড়েছে? এই অচেনা-অজানা নির্বান্ধব দেশে তারা কি করে আত্মরক্ষা করবে? প্রতিপক্ষ সহজ নয়, ওরা মর্টার নিয়ে আক্রমণ করতে এসেছে। ওদের সঙ্গে কত লোক আছে কে বলবে? এরা সংখ্যায় বড় কম হবে না তা না হলে এরা এভাবে আক্রমণ করতে সাহস করত না। যারা আক্রমণ করছে, তারা ঝোপঝাড়ের আড়ালে এমন সুকৌশলে অত্মগোপন করে আছে যে, রাস্তা থেকে তাদের কোন মতেই দেখা যায় না। ট্রাক নিয়ে সেই দিকে এগোবার উপায় নেই, যেতে হলে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। কিন্তু সেটা কোনমতেই নিরাপদ নয়। ওদের সঙ্গে শুধু মর্টার নয়, মেশিনগানও আছে। একপশলা বৃষ্টির মত কয়েক ঝাঁক মেশিনগানের গুলি ট্রাকের উপর এসে পড়েছে। প্রথম পর্যায়েই সৈন্যদের কয়েকজন মারাত্মকভাবে জখম হয়ে পড়েছে। সৈন্যরা আর দেরী না করে আনুমানের উপর নির্ভর করে মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে লাগল। তাদের মেশিনগানও অবিরাম কাজ করে চলেছে।

 এইভাবে কয়েক ঘণ্টা ধরে দুই পক্ষের গোলাগুলির বর্ষণ চলল, একে রীতিমতো যুদ্ধ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। এই কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে পাক সৈন্যদের নিদারুণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মর্টার আর মেশিনগানের