পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৭৫

দিকে বুকে হেঁটে (ক্রলিং করে) শিবিরের দিকে অগ্রসর হন। তারা লক্ষ্য করলেন যে, অভ্যন্তরে বঙ্গালী কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বরং কয়েকজন পাঞ্জাবী জোয়ান বাইরের সাহায্যের প্রতীক্ষায় তখনও পূর্বদিকের গেট পাহারা দিচ্ছে। সুযোগ বুঝে এরা তিনজন বালিকা বিদ্যালয়ের গা ঘেঁষে অগ্রসর হন এবং পাহারারত এই পাঁচজন পাঞ্জাবী সৈনিকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের খতম করে দেন। অতঃপর ভেতরে প্রবেশ করে তারা আরও ৮ জনকে হত্যা করেন এবং আহতদের বেয়নেট দিয়ে শেষ করেন। দক্ষিণ পাশে অফিস সংলগ্ন অয়ারলেস সেণ্টারের অপারেটরদের মধ্যে জীবিত দুজনকে তারা এস এম-জির ব্রাশ করে খতম করে ফেলেন। এই নিধনযজ্ঞ সমাপ্ত করে তারা আবার ছাউনিতে ফিরে এসে চতুর্দিক থেকে বাইরের লোক আহববান করেন। বাঙ্গালী কণ্ঠের আওয়াজ পেয়ে চারদিক থেকে লোকজন এসে পড়লো। এদের মধ্যে ই,পি, আই, ডিসির শ্রমিক নেতা আবদুল মোতালেব ও প্রচুর ছাত্র ও শ্রমিক ছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো হেমায়েতের নেতৃত্বে অস্ত্র অপসারণ।

 এখান থেকে হেমায়েতউদ্দিন শতাধিক অস্ত্র, প্রচুর গোলাবারুদ, ৩টি গাড়ী এবং কয়েকজন জোয়ান নিয়ে পূর্ব দিকে মাত্র হাইস্কুলে চলে যান। অবশ্য দু'দিনের মধ্যেই ২০ জন ছাড়া বাকী সকলেই অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। অবস্থা দেখে ৩০শে মার্চ তিনি এই ২০ জন জোয়ানসহ কাপাসিয়া থানার দিকে অগ্রসর হন। সেখানে পৌঁছে তিনি জানতে পারলেন ২৭শে মার্চ রাত্রে জয়দেবপুর থেকে মেজর কে. এম শফিউল্লাহর নেতৃত্বে বেরিয়ে আসা বাহিনী এখান দিয়ে চলে গেছে। ইতিমধ্যেই পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ জোরদার হবার ফলে কাপাসিয়া অবস্থান নিরাপদ নয় দেখে হেমায়েতউদ্দিন তাঁর লোকজন নিয়ে একটা বিশেষ লঞ্চে বর্মী গমন করেন। যেখান থেকে পায়ে হেঁটে ঢাকা-ময়মনসিংহ সীমান্ত বরাবার ‘কাওরাইদ’ নামক স্থানে পৌঁছেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সুবেদার আবুল বাশার ও নায়েব সুবেদার মীর মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে এখানে একটি প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে উঠেছিল। হেমায়েত তাঁর ২০ জন সঙ্গীসহ এখানে তাদের সাথে যোগদান করেন। এই ক্যাম্প সেনাবাহিনীর লোকের চেয়ে আনসার ও মোজাহিদ বাহিনীর লোক বেশী থাকার ফলে তাদের কার্যকলাপে ‘কাওরাইদ' ক্যাম্পে বিশৃংখলা দেখা দেয় এবং নিয়মিত বাহিনীর জোয়ানদের মন বিগড়ে যায়।

 ফলে ৯ই এপ্রিল ফরিদপুর ও বরিশালের মাত্র ১১ জন সংগী নিয়ে হেমায়েত ফরিদপুর রওয়ানা হন। তার সাথে কাপাসিয়ার ইব্রাহিম নামক একটি যুবকও ছিল। এদের প্রত্যেকের সাথে ছিল ১টি করে চাইনিজ রাইফেল ও ৮০০ রাউণ্ড গুলি। এ ছাড়া ২টি হালকা মেশিনগান, ৪টি চাইনিজ এস,এম,জি ও ৪০০০ গোলা- বারুদও তাদের সাথে ছিল। গ্রাম থেকে লোক ধরে এনে তাদের দিয়ে বোঝা টানিয়ে এবং পথ দেখিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছিলেন। গজারী বন পার হয়ে ঢাকা-মযমনসিংহ সড়কে পাকবাহিনীর একটি ইউনিটকে তারা আক্রমণ করেন। এই সংঘর্ষে হেমায়েতর ৪ জন সংগী শহীদ হয়ে যান। কিন্তু তারা পাক-বাহীনির ৫ খানা জীপসহ বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেন।

 এভাবে কয়েকটি অপারেশন চালিয়ে অবশেষে ১৭ ই এপ্রিল অপরাহ্ন ২টায় এক জেলে নৌকায় পদ্মা পাড়ি দিয়ে হেমায়েত ও তার সঙ্গীরা নারারটেক চরে অবতরণ করেন। তারা ফরিদপুর পৌঁছে খন্দকার ওবায়দুর রহমান ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতার সাথে জেলা বোর্ডের কমলাপুরস্থ ডাকবাংলায় দেখা করেন এবং জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সুপারের সাথে দেখা করে পুলিশ বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ন্ত্রণ হাতে পাবার দাবী করতে থাকেন।

 ইতিমধ্যে ২১ শে এপ্রিল প্রত্যুষে পাকবাহিনী গোয়ালন্দে পৌঁছে যায় এবং ফরিদপুর শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের প্রতিহত করার কাজে সংশিষ্ট কারো সহযোগিতা না পাওয়ায় সঙ্গীদের নিয়ে তিনি ভাঙ্গা উপস্থিত হন। সেখানে কিছু প্রশিক্ষণহীন যুবক প্রতিরোধ রচনার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে দলাদলি দেখে হেমায়েতউদ্দিন নৌকাযোগে টেকেরহাট হয়ে 'বাঘিয়ার বিল' অতিক্রম করে ২৬শে এপ্রিল ‘ফান্দি’ নিজ গ্রামে বাড়ীতে উপস্থিত হন। তার গ্রামের নিরীহ জনসাধারণ ও আত্মীয়স্বজন ইতিমধ্যেই পাক- বাহিনীর অত্যাচারের