পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৭৬

কথা শুনে এবং দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। হেমায়েত বাড়িতে যেতেই নিরীহ গ্রামবাসীর তাকে এ বিদ্রোহের পথ পরিত্যাগ করতে অনুরোধ করে, আর দালাল দুর্বৃত্তরা ভয় দেখাতে থাকে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হেমায়েতর স্ত্রী হাজেরা ৭ই মে এক দুর্ঘটনার মারা যায়। চান মিয়া নামক একজন মাতবর শ্রেণীর লোক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে দল পাকাতে শুরু করলে ৯ই মে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অতঃপর হেমায়েত বাড়ি থেকে লোকজনসহ পার্শ্ববর্তী 'পিঠা বাড়ী' গ্রামে চলে যান। অবশ্য তিনি তার সাথীদের আগেই বিদায় করে দিয়েছিলেন। ইব্রাহিম এবং সোলায়মান ছাড়া আর কেউ তার সাথে ছিলো না।

 ৯ই মে চাঁন মিয়ার হত্যার দিনই কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ থানা থেকে পুলিশ ও পাকবাহিনী এসে হেমায়েতের বাড়ি পুড়িয়ে তার শেষ আকর্ষণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এরপর হেমায়েত বেপরোয়া হয়ে উঠেন এবং সত্যিকারভাবে নতুন করে সংগ্রামের জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন।

 কয়েকদিন পর ১৪ ই মে ভোরবেলা হেমায়েত তাঁর সঙ্গী ইব্রাহিম ও সোলায়মানকে নিয়ে কোটালীপাড়া থানা আক্রমণ করে বসেন। তাদের আধুনিক অস্ত্রের মার এবং বেপরোয়া বীরত্বের কাছে মুহূর্তেই ৫৪ জন পুলিশ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। অভ্যন্তরীণভাবে শক্তি সঞ্চয় করে এ ধরনের সাফল্য গ্রাম বাংলায় এটাই প্রথম! এতে স্থানীয় জনসাধারণ বিপুলভাবে উৎসাহিত হল। হেমায়েত থানা থেকে ৫ মণ চাউল ও অন্যান্য রসদ নিয়ে বাঘিয়ার বিলের কলাবাড়ী গ্রামের চিত্ত গয়ানের বড়িতে চলে যান। পরে পীরের বাড়ীর আওয়ালী লীগ কর্মী লক্ষ্মীকান্ত বলের অনুরোধে হেমায়েত তার গ্রামে ঘাঁটি স্থাপন করেন। এ সময় গৌরনদী অঞ্চলের ১২ জন সশস্ত্র জোয়ান ও কিছু ছাত্র হেমায়েতের সাথে যোগ দেয়।

 পাকবাহিনীর লোকেরা নদীপথে খোঁজাখুঁজি করলেও বিলের অভ্যন্তরে মোটেও প্রবেশ করত না। তবে এখানে দল সংগঠনে তেমন সুবিধা না হওয়ায় হেমায়েত গৌরনদী চলে যান এবং ২৯শে মে বরিশাল গৌরনদী থানার ‘বাটরা বাজারে' আনুষ্ঠানিকভবে হেমায়েত বাহিনী উদ্বোধন করেন। এর আগে ২৬শে মে তারিখে এক সফল আক্রমণের ফলে এই বাটরা বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।

 শীঘ্রই বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা এই বাহিনীতে যোগ দিতে আরম্ভ করে। স্থান সংকুলানে অসুবিধা হওয়ায় পশ্চিম দিকে পয়সার হাটের উত্তরে রাজাপুর নামক গ্রামে তিনি সদর দফতর স্থাপন করেন।

 ১লা জুন বরিশাল ও ফরিদপুরের এই অঞ্চলে স্বধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। দেশের এই অঞ্চলই সর্বপ্রথম মুক্ত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্টা লাভ করে। মুজিবনগর বেতার কেন্দ্র থেকেও এ কথা প্রচার করা হয়।

 ৩রা জুন পাকবাহিনীর এক বিরাট দল কোটালীপাড়া থানায় উপস্থিত হয় এবং রাত্রে নৌকাযোগে কোটালীপাড়া ও পয়সার হাটের খাল বেয়ে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করতে এগিয়ে য়ায়। এই দলে ১২ খানা নৌকায় পুলিশ, লাঠিয়াল ও পাকবাহিনীর প্রায় ৩০০ লোক ছিল। রাত দু'টায় হেমায়েত তার বাহিনী নিয়ে অগ্রবর্তী ‘হন্যহাটি' নামক স্থানে উপস্থিত হয়ে খালের দু'পার থেকে এদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। পথে এই আক্রমণের জন্য পাকবাহিনীর প্রস্তুত ছিল না; তাই এই আতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তবে হেমায়েত বাহিনীর ইব্রাহিম শাহাদাৎ বরণ করেন। এই আক্রমণের ফলে ২৪ জন পুলিশ ও লাঠিয়াল ধরা পড়ে।

 এই নাজেহাল অবস্থায় প্রতিশোধ নেবার জন্য ৭ই জুন পুনরায় তখানা ‘স্টীল বডি' লঞ্চ নিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে পাকবাহিনী ‘রাজাপুর' ঘাঁটি আক্রমণ করে। হেমায়েত কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে লঞ্চগুলোকে পেছন দিক থেকে আক্রমণ করেন। অপর দিকে ঘাঁটির বাঙ্কার থেকে সামনের দিক গিয়ে গোলাবর্ষণ শুরু করা হয়। উপায়ন্তর না দেখে লঞ্চগুলো পালাতে শুরু করে এবং শাতলা গ্রামের বাঁক ঘুরে কোন রকমে পালিয়ে রক্ষা পায়।