পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৭৭

এই দৃশ্যে জনসাধারণ বিপুলভাবে আনন্দিত হয়। তারা হেমায়েত বাহিনীর এই দলটিকে কাঁধে তুলে ‘পয়সার হাঁটে' নিয়ে আসে। সেখানে তড়িঘড়ি এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়ে যায় এবং হেমায়েতকে জনসাধারণ ‘মেজর’ খেতাবে ভূষিত করে। এই যুদ্ধের ফলে প্রায় ২০ মাইল এলাকা মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হয়। এই সময় শাতলা গ্রামে নদীর বাঁকে একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটিও স্থাপন করা হয়।

 এরপর রাজাপুর থেকে সরে গিয়ে জহরের কান্দি হাইস্কুলে ঘাঁটি স্থাপন করে সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। দলে দলে যুবক-ছাত্র জনতা এসে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে লাগল। পক্ষান্তরে এ সময় ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলারাও কিছু কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসে দলে ভিড়তে লাগলো। অতঃপর, কালকিনি থানার চলবল গ্রামে অপারেশন ঘাঁটি সরিয়ে নেয়া হয়। ১১ই জুলাই টুঙ্গীপাড়া শেখ বাড়িতে দেড়শত পাঞ্জাবী সৈন্যের বিরুদ্ধে এক সফল আক্রমণ পরিচালনা করা হয়।

 ১৪ই জুলাই পাকবাহিনী মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও টেকেরহাট-এই তিন দিক থেকে আবার চলবলের ঘাঁটির উপর হামলা চালায় এবং ক্যাম্পের কাছে রামশীল নামক গ্রামে ঢুকে পড়ে। হেমায়েতের সাথে তখন মাত্র ১৩ জন সঙ্গী ছিলো। এদের নিয়েই তিনি অগ্রসর হন এবং এই হামলা প্রতিহত করার প্রয়াস পান।

 রামশীল গ্রামের মধ্যে দিয়ে একটি খাল গৌরনদী থানার বাসাইল গ্রামের দিকে চলে গেছে। গৌরনদী থেকে ঐ খাল বেয়ে হানাদার বাহিনী আসতে পারে ভেবে পূর্ব দিকে মুখ করে ৩ জন, দক্ষিণ দিকে মুখ দিয়ে ৩ জন এবং সংকেত দেবার জন্য বাইরে একজন বসানো হলো। অতঃপর হেমায়েত বাকী ৬জন পশ্চিমমুখী হয়ে বসলেন। কোটালী পাড়া বান্দাবাড়ী খালের মধ্যে দিয়ে হানাদার বাহিনী অগ্রসর হতে পারে মনে করেই তিনি এ জায়গায় অবস্থান নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে এদিক থেকেই হানাদারদের অগ্রগামী বাহিনী দেখা গেল। তারা কাছাকাছি আসতেই হেমায়েত মেশিনগানের গুলি চালালেন। তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ শত্রুপক্ষের একটা বুলেট তার সহকর্মী মকবুলের মাথায় খুলি ভেদ করে চলে গেলে সে তৎক্ষণাৎ মারা যায়। মকবুলের লাশ টানতে যেতেই একটা শেলের টুকরো হেমায়েতের গালের বাঁ পাশ দিয়ে ঢুকে ডান পাশ দিয়ে বেরহয়ে গেল। এতে জিহবার খানিকটা কেটে গেল এবং কয়েকটা দাঁতও পড়ে গেল। তবুও তিনি কর্তব্যচ্যুত হলেন না। বরং অসীম সাহস আর প্রবল প্রতাপের সাথে পাল্টা আক্রমণ রচনা করে চললেন। এভাবে দীর্ঘ সময় তুমুল সংঘর্ষের পর হানাদার বাহিনী পিছু হটতে শুরু করলো। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর প্রচুর হতাহত হয়। যুদ্ধের পর হেমায়েত বুঝতে পারলেন যে আঘাত খুবই সাংঘাতিক, ফলে তাকে দীর্ঘদিন রাজ্যেশ্বর ডাক্তারের চিকিৎসায় থাকতে হয়।

 একস্থানে বেশী দিন ঘাঁটি রাখা যায় না। কারণ, পাকবাহিনীর খোঁজ পেলেই সেখানে আক্রমণের আশংকা দেখা দেয়। তাই রামশীলের যুদ্ধের পর আর চলবল ঘাঁটি রাখা মোটেই নিরাপথ নয়। তাছাড়া যে কোন সময় বিমান আক্রমণ ও অসম্ভব নয়। তাই ঘাঁটি সরিয়ে গোপালগঞ্জের পূর্ব সীমান্তে বিলের উত্তর প্রান্তে ‘রুথিয়ার পাড়ে’ একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে ছাউনি ফেলা হলো। এ বড়ির প্রায় সকলেই ভারতে চলে গিয়েছিল। পাঁচখানা দোতলা ঘর নিয়ে বেশ বড় বাড়ি। এখানেই জুলাই মাসের শেষ দিকে এসোসিয়েটেড প্রেসের' একজন সাংবাদিক হেমায়েতের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই সাক্ষাৎকরের বিবরণ দি সান' নামক পত্রিকার ৪ঠা আগষ্ঠ সংখ্যায় হেমায়েতের ছবিসহ প্রকাশিত হয়।

 ওদিকে কোটালীপাড়া থানায় পুনরায় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাদ্যশস্য মওজুদ করার খবর পাবার পর ১৫ই সেপ্টেম্বর তারা আবার কোটালী পাড়া থানা আক্রমণ করেন। ১৪ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর থানা দখলে আসে। প্রচুর খাদ্যশস্য ও গোলাবারুদ হস্তগত হলো। অতঃপর হেমায়েত বাহিনী ৩রা ডিসেম্বর শেষবারের মত কোটালী পাড়া থানা দখল করেন।