পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৭৯

দলের ৪ জন সদস্য স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিরে যান। ৬ই জুন আমরা ঢাকা শহরে প্রবেশ করি। ঢাকায় এসে আমরা জানতে পারলাম যে ৯ই জুন হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালে সামরিক জান্তা এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্রিন্স সদরুদ্দিনসহ অর্থনৈতিক সাহায্যদাতা সংস্থার বেশকিছু প্রতিনিধি এবং বিদেশী সাংবাদিক এসেছিলেন। তারা হোটেল ইণ্টারকনে ছিলেন। সামরিক জান্তা তাদের ভেতর প্রচার করেছিল যে ঢাকা শহর সম্পূর্ণ শান্ত। দেশের কোথাও মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে না, শুধু সীমান্ত এলাকায় সামান্য গোলমাল ছাড়া। আমরা সেই ধারণা পাল্টানোর জন্য প্রথমে ইণ্টারকনে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। অপারেশনের দিন ঠিক করা হয় ৯জুন। কারণ, ঐদিন রাত ৭-৩০ মিনিটে বিদেশী সাংবাদিক ও সাহায্যদাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের সম্মানে সামরিক জান্তা নৈশভোজের আয়োজন করে।

 অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে প্রথমে আমরা ইণ্টারকনে ‘রেকি’ করি। আমরা সব সময় 'রেকির' ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতাম। কারণ, অভিযানের সাফল্য শতকরা ৯০ ভাগ নির্ভর করে সঠিক ‘রেকি'র ওপর। রেকিতে আমার সঙ্গে ছিলো আলম ও জিয়া। রেকি করার দিন বিকেলবেলা একটি গাড়িতে করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই আমরা হোটেলের সামনে নেমে ভেতরে যাই। প্রথম আমাদের কাজ ছিলো অপারেশনটা কিভাবে পরিচালনা করা যায় সে সম্পর্কে হোটেলের ভেতরের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেয়া। সিদ্ধান্ত মোতবেক রেষ্টুরেণ্টে যাই এবং কিছু খাওয়া-দাওয়ার ছলে আমাদের প্রয়োজনীয় সময় ব্যয় করে ভেতরের সকল অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হয়ে ফিরে আসি। শেলটারে ফিরে আমরা দলগতভাবে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে পর্যালোচনা করার পর আক্রমণের কৌশল নির্ধারণ করি। আমরা শুধুমাত্র গ্রেনেড ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ৬ জনের একটি দল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অপারেশনের জন্য একান্তভাবে গাড়ির প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের কোন গাড়ির ব্যবস্থা ছিলো না।

 ইণ্টারকনে যেদিন অপারেশন করেছিলাম সেইদিন সন্ধ্যা আনুমানিক ৬-৩০ মিনিটের পর গুলশান থেকে একজন অবাঙ্গালীর একটি গাড়ি জোরপূর্বক সংগ্রহ করা হয়। ঐ গাড়িতেই ৬ জনের ‘অপারেশন গ্রুপ” নিয়ে আমরা রওয়ানা হই। বাদল মামা গাড়ি চালাচ্ছিলেন। গাড়ির সামনের সিটে ছিলেন চুলু ভাই ও স্বপন। পেছনে আমি জিয়া ও আলম। হোটেলের সামনের দিকে গাড়ি থামিয়ে আমরা তিনজন নেমে পড়লাম। তখন ইণ্টারকনে সামনের দিকটায় উঁচু কয়েকটি গাছ ছিলো। গাড়ি থেকে নেমে সামনের দেয়াল টপকে আমরা ভেতরে প্রবেশের করে অবছা অন্ধকারে গাছের আড়ালে চলে যাই। ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের সময় অতিবাহিত হচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে আমরা তীক্ষ্মতার সঙ্গে লক্ষ্য করে হোটেলের মূল প্রবেশ পথে পরপর তিনটি গ্রনেড ছুড়ে ফেলি। গ্রেনেডগুলো বিস্ফোরিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা গাছের আড়ালেই দাঁড়িয়ে থাকি। ইতিমধ্যে বিস্ফোরণের শব্দে লোকজনের ছুটোছুটি, চিৎকার শুরু হয়েছে। আমরা দেয়াল টপকে তড়িৎ গতিতে গাড়িতে উঠে পড়ি।

 আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গাড়ি ঘুরিয়ে আমরা চলে যাই রমনা থানার কাছে জনৈক জামাত নেতার বাড়িতে। সেখানে তখন হানাদার বাহিনীর তাবেদার শান্তি কমিটির লোকজনের এক সম্মেলন চলছিলো। আকস্মিকভাবে আমরা গাড়ি নিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়ে পরপর তিনটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে চোখের নিমেষে গাড়ি ঘুড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে যাই। সেদিন আমাদের সিদ্ধান্ত ছিলো ইণ্টারকনে অপারেশন সফল হলে ঢাকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আক্রমণ করা। তাই রমনা থেকে সোজা চলে যাই 'দৈনিক পাকিস্তান' (দৈনিক বাংলা) ও ‘মনিং নিউজ' সংবাদ-পত্র অফিসের সামনে। চলন্ত অবস্থায় সেখানে ২ টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আমরা পুরানা পল্টনের গলিতে ঢুকে পড়ে সেখানে গাড়ি ফেলে নিরাপদে ফিরে যাই।

 ঢাকা শহরের একই দিনে আমরা তিনটি সফল আক্রমণ পরিচালনা করেছিলাম। সেদিনের ঘটনা আজো আমার স্মৃতিতে ভাসে, কারণ, এই আক্রমণ ছিলো ঢাকা শহরের প্রথম সকল গেরিলা অভিযান।