পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৮৭

সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে বললেন। এরপর আমি ঢাকায় আসি। ঢাকায় এসে আমি কিছু ছেলে জোগাড় করি এবং পুনরায় ২২ মে ঢাকা ত্যাগ করি এবং মতিনগরে উপস্থিত হই। আমাদের সেখানে ট্রেনিং নিতে দেয়া হয়নি। এই সময় কামাল লোহানীর সাথে আমার দেখা হয়। তিনি আমাকে স্বাধীন বাংলা বেতারে নিয়ে যান। সেখানে আমি দুই সপ্তাহকাল অবস্থান করি। স্বাধীন বাংলা বেতারে আমি কিছু কবিতাও পাঠ করি। সেখানে নওগাঁর জলিল সাহেবের (এম-পি) সাথে আমার দেখা হয়। আমি সরাসরি যুদ্ধ করতে চাই এই ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমাকে তিনি তাঁর দিনাজপুর ক্যাম্পে ট্রেনিং নিতে বলেন। আমি সাথে সাথে রাজী হয়ে যাই এবং ২৭ জন ছেলেসহ পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট ট্রেনিং নিতে শুরু করি। আমার ছেলেদের মধ্যে ছিল আসাদ, ওমর, পনির, মঞ্জু, ইফতেখার, তৌফিক প্রমুখ ছাত্র। সেখানে ৪৫ দিনে আমাদের ট্রেনিং আমাদের ট্রেনিং সমাপ্ত হয়।

 এর মধ্যে ট্রেনিং চলাকালে আমি কলকাতায় আসি। কলকাতায় মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে আমার দেখা হয়। তিনি তখন ২নং সেক্টরের অধিনায়ক। ঢাকা যেহেতু ২নং সেক্টরের অধীনে ছিল, সেহেতু তিনি আমাদের ২৭ জনকেই দিনাজপুর থেকে আগরতলায় তাঁর অধীনে নিয়ে আসেন। এর প্রধান কারণ ছিল আমরা ছিলাম ঢাকার বাসিন্দা।

 মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে পুনরায় আমাদের ১৫ দিনের একটি ব্রাশ-আপ ক্লাশ হয়। সেখানে তিনি আরো ২৫ জন ছেলেকে সঙ্গে দিয়ে মোট ৫২ জনের একটি টিম তৈরী করেন এবং সবাইকে ঢাকা উত্তরের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। আমরা প্রথমে তিতাসের ভেতর দিয়ে ঢুকতে শুরু করি। আখাউড়া- ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের একটি ব্রিজের নিচ দিয়ে আমরা গভীর রাত্রিতে ঢুকতাম। এর পাশের গ্রামটি ছিল মনিহন। সেই সাথে আমরা প্রথম ঢুকি সেপ্টেম্বর মাসে।

 পাকবাহিনী ঐ ব্রিজের ওপর মোতায়েন ছিল। একদিন পাকসেনারা ব্রীজের ওপর থেকে আমাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের সাথে ফরিদপুরের একটি দল সেই পথে অগ্রসর হচ্ছিল। এ আক্রমণে অগ্রগামী দলটির ১৪ জন ঘটনাস্থলে মারা যায়। ঐ ঘটনার দুই দিন পর আমরা সেখানে পেনিট্রেট করি এবং তিতাসে এসে পৌঁছি। সেখান থেকে আমরা ধামরাই থানার এক গ্রামে এসে উপস্থিত হই।

 এই গ্রামে আসতে আমাদের সাত দিন সাত রাত লেগেছিল। সেই রাতগুলো ছিল ভীষণ ভয়াবহ। দু'দিন দু'রাত আমরা স্রেফ নদীর পানি খেয়ে কাটাই। কারণ, আমাদের রেশন ফুরিয়ে গিয়েছিল। নদীতে যে সমস্ত গয়নার নৌকা যাতায়াত করতো সে সমস্ত নৌকার মাঝিদের সহায়তায় পাটাতনে লুকিয়ে থেকে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতাম। এ ব্যাপারে মাঝিদের ভূমিকা ছিল খুবই নির্ভীক। বলতে গেলে এঁরা আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি জড়িত ছিল।

 এবার আমরা রোহার একটি ছোট্ট বাজারে এসে উঠি এবং সেখানে যখন আমরা রাত্রিযাপন করছিলাম, তখনই হঠাৎ পাকবাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। আমরা যে সেখানে এসেছি এই কথা দালালেরা ইতিমধ্যে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই আক্রমণ আমরা প্রতিহত করি। সেদিনের ঐ পাল্টা আক্রমণে আমাদের দলের আশরাফ নামে এক ছেলে (বি,ডি,আর সুবেদার) অত্যন্ত সাহসের সাথে যুদ্ধ করে। সেই যুদ্ধে আমরা ১৯ জন পাকসেনার প্রাণনাশ করি। পাকবাহিনী নিরুপায় হয়ে সেই স্থান ত্যাগ করে এবং ফিরে যাওয়ার পথে গ্রামের নিরীহ জনগণের উপর অত্যাচার চালায়, তাদের ঘরবাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগ করে।

 এরপর রোহা ছেড়ে আমরা সিঙ্গাইর থানা এলাকার কাছাকাছি একটি গ্রামে ক্যাম্প করি। এখানে আমরা একটি অপারেশন করি। এই অপারেশনে ১৪ জন পাকসেনার একটি রেশনিং কোরকে আক্রমণ করি এবং সবকটা পাকসেনাকে খতম করি। এরপর আমরা সেই স্থান থেকে আমাদের ক্যাম্পকে নিরাপদ এলাকায় নিয়ে আসি। এই নতুন স্থানটির নাম ছিল শিমুলিয়া। এখানে এসে আমরা ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করি। এভাবে আমাদের আক্রমণের পরিধি ক্রমশঃ বিস্তার লাভ করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে ২৩ জনের একটি সংঘবদ্ধ দল নিয়ে মূল