পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩১

আমাদের এখন ফিরে যেতে হবে ক্যাণ্টনমেণ্টে। বাঙালী সৈন্য যারা তার সাথে যাচ্ছিলেন তাঁদেরকে ইশারায় বললেন। রাইফেল লোড করে রাখতে প্রয়োজন হতে পারে।

 তাঁরা ফিরে আসেন ব্যাটালিয়নে। এসেই তিনি সাথের পশ্চিমা অফিসারকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি এখন আমাদের হাতে বন্দী। অফিসারটি আত্মসমর্পণ করলে তিনি ট্রাক থেকে নেমে ট্রাকের পশ্চিমা নৌ-সেনাদের দিকে রাইফেল তাক করে তাদেরকেও অস্ত্র ছেড়ে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। হকচকিত পশ্চিমা সেনারা সবাই অত্মসমর্পণ করে।

 এরপর তিনি একাই গাড়ি নিয়ে ছুটে যান অফিসার কমাণ্ডিং জানজুয়ার বাড়ি। কলিং বেল টিপতেই ঘুম ভেঙ্গে উঠে আসেন জানজুয়া। আর সামনেই মেজর জিয়াকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে ওঠেন। তার ধারণা ছিল পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর জিয়া বন্দরে বন্দী রয়েছে। জানজুয়াকে গ্রেফতার করে নিয়ে ষোলশহরে ফিরে আসেন মেজর জিয়া। পথে অফিসার্স মেসে মেজর শওকতকে তিনি সব কথা বলতেই মেজর শওকত উৎফুল্ল হয়ে উঠেন এবং বিদ্রোহে তাঁর সাথে যোগ দেয়ার কথা ঘোষণা করে দ্রুত ব্যাটালিয়নে চলে আসেন।

 এরপরই মেজর জিয়া টেলিফোনে স্থানীয় জননেতা ও বেসামরিক অফিসারদের সাথে যোগাযোগ চেষ্টা করেন। কিন্তু কাউকেই পান না। তখন টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অপারেটরকে জানালেন সবাইকে টেলিফোন করে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের বিদ্রোহ ঘোষণার কথা জানাতে। অপারেটর সানন্দে তাঁর সে নির্দেশ জানাতে রাজী হন।

 তিনি লেঃ কর্নেল এম, আর, চৌধুরীকেও টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁকেও পাননি। পরে শুনেছিলেন এই রাতেই পাকিস্তানী সৈন্যরা গুরুতর অসুস্থ এম, আর, চৌধুরীকে হত্যা করেছিলো।

 শুরু হয়ে গেল বিদ্রোহ। রাত তখন দুটো। ব্যাটালিয়নের আড়াইশোর মত বাঙ্গালী সৈন্যকে একত্রিত করে তাঁদেরকে সব কথা বলেন মেজর জিয়া। সবাই একবাক্যে এই বিদ্রোহের প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন। তাঁরা জানান, দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁরা জান দিতে প্রস্তুত। কিছু সৈন্য ষোলশহরে রেখে বাকী সবাইকে নিয়ে মেজর জিয়া বেরিয়ে পড়েন কালুরঘাটের পথে। এদিকে ই-পি-আর এর জোয়ানরাও লড়াই শুরু করেছিলেন। কালুরঘাটে পরদিন তাঁদের সাথে বেশকিছু পুলিশও যোগ দেন।

 ২৬শে মার্চ সকাল। আগের রাতে ঢাকা শহরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে রাজধানীর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল পাকিস্তানী বাহিনী। আর সেই আনন্দে সকাল হতেই পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের সদর দফতরে চলছিল মিষ্টি বিতরণ আর অভিনন্দন বিনিময়ের পালা। কিন্তু মুহূর্ত কয়েক পরেই তাদের মুখের হাসি ম্লান হয়ে যায়। মিষ্টি হয়ে যায় বিস্বাদ। চট্টগ্রামের যুদ্ধের খবর যখন তাদের কাছে পৌঁছলো তখন এক দারুন সন্ত্রাসে আঁতকে উঠলেন তারা।

 চট্টগ্রাম। পাকিস্তানীদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো চট্টগ্রাম। ২৭শে মার্চ সকালেই বিমান বোঝাই হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে গেল পুরো দ্বিতীয় কমাণ্ডো ব্যাটালিয়ন। চট্টগ্রামে যুদ্ধের পরিকল্পনা তৈরীর জন্য মিঠা খানকে হেলিকপ্টারে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে। বাঙ্গালী সৈন্যরা গুলি করে, সে হেলিকপ্টারটি ফুটো করে দেয়। একই সাথে বিমানে করে নামানো হতে লাগলো দ্বিতীয় কমাণ্ডো ব্যাটালিয়নকে। নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বাবরকে নিয়ে আসা হয় বন্দরে। এতে ছিল দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য। ডেস্ট্রয়ার, এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্কও লাগানো হয় এই যুদ্ধে। জাহাজের গান থেকেও গোলা নিক্ষেপ হতে থাকে শহরের দিকে।

 এই বিরাট শক্তির মোকাবিলায় বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব হবে না একথা বাঙ্গালী সৈন্যরা বুঝেছিলেন। তাই শহর ছেড়ে যাবার আগেই বিশ্ববাসীর কথা জানিয়ে যাবার জন্য মেজর জিয়া ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান। বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা মেজর জিয়াকে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। কিন্তু কি বলবেন