পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৮

পাই। প্রত্যেক লাশকে চারজন সৈন্য হাত পা ধরে মরা কুকুরের মত নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে সৈন্যকে কয়েকটি লাশ মাটিতে ছেঁচড়িয়ে নিয়ে যেতে দেখতে পাই।

 এই সময় কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী জুনিয়র অফিসারকে দেখতে পাই। তারা আমাকে বাঁধা অবস্থায় দেখে দুঃখ প্রকাশ করে। একজন ২০-বেলুচের লেফটেন্যাণ্ট কোয়ার্টার মাস্টার কেঁদে ফেলেছিল।

 বেলা তিনটার দিকে কর্নেল ফাতমী (২০ বেলুচের কমাণ্ডিং অফিসার) ই-বি-আর-সি এলাকাতে আসেন এবং আমাকে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেয়ে মনঃক্ষুন্ন হন। তিনি এক হাবিলদারকে আমার বাঁধন খুলে দিতে নির্দেশ দিলেন। আমি লেফটেন্যাণ্ট আবু তালেবের কথা বলাতেও তিনি তার বাঁধন খুলে দিতে নির্দেশ দেন। অনুরোধ করাতে সুবেদার মেজর রুহুল আমীন ও নায়েক সুবেদার কোয়ার্টার মাস্টার লুৎফর রমানের বাঁধন খুলে দেয়া হয়। আর লুৎফর রহমানকে বলেন। তুমি একটি মেগাফোন নিয়ে যে সমস্ত লোক পাহাড়ের উপর বা অন্যান্য জায়গায় আছে তাদেরকে আত্মসমর্পন করতে আহ্বান জানাও। তারা যদি খালি হাতে হাত উঁচু করে আসে তাহলে তাদেরকে কেউ মারবে না। পরক্ষনে তিনি সমস্ত বাঙ্গালী সৈন্যের হাতের বাঁধন খুলে এক জায়গায় একত্রিত করতে নির্দেশ দেন। তাই করা হল। আমাকে বলেন যে তুমি গিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে পার। তবে তাদের উপর আর কোন অত্যাচার করা হবে না।

 আমি গিয়ে সকলকে একত্র করে তাই বললাম। ৫০০/৬০০ জন বাঁধা অবস্থায় ছিল। পুনরায় কর্নেল ফাতমীর সাথে দেখা করলে তিনি আমাকে বলেন, “এ্যানি হয়ার ইউ ওয়াণ্ট টু গো ইউ ক্যান গো। ইফ ইউ ওয়াণ্ট টু স্টে ইন অফিসার মেস, গো এহেড। বেটার গো হোম।”

 আমি অন্যদের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে নির্দেশ পেলে তাদরকেও ছেড়ে দেয়া হবে।

 আমি দুজন সিপাহী নিয়ে মেসে টাকা আনতে যাই। ওখানে প্রহরারত হাবিলদার পাঞ্জাবী ভাষায় আমার প্রহরারত সিপাহীদের বলল, সাহেব যখন ভেতরে যাবে তখন তাকে হত্যা কর। আমি শুনতে পেয়ে একটু সামনে যেয়ে আবার ফিরে এসে বললাম। ওস্তাদ আব লোগ কোকাকোলা ফাণ্টা পিয়া। হামারা নাম পর পিলে। হামে এক বাদ ইয়াদ আয়া, কর্নেল সাব নে বাতায়া সি-এম-এইচ ছে ডাক্তার লে কর জখমী কো পহেলা দেখনে কি লিয়ে। হাম ফের থোর বাদমে আয়েঙ্গে। এ যাত্রা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাই।

 তারপর আবার কর্নেল ফাতমীর সাথে দেখা হয়। আমি তাকে বলি, আমার লোকজনের খাবারের কোন ব্যবস্থা আছে? তিনি বলেন। আমাদের লোক নিয়ে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করুন। না হয় তারা কষ্ট পাবে।

 তিনি আরো বলেন ই-বি-সি-র সামনে কোন পশ্চিম পাকিস্তানী থাকবে না। রাত্রে তাদের কোন অসুবিধা হবে না। এখানে বলা যেতে পারে ই-বিআর-সির সামনের জায়গাটা হল বায়েজিদ বোস্তাম ও বেসামরিক লোকদের বাড়িঘর। লোকজনকে একত্র করে পুনরায় আমি তাদের খাবারের ব্যবস্থার জন্য বলি। আর বলি, আমাকে, লেফটেন্যাণ্ট তালেব, সুবেদার মেজর রুহুল আমীন ও নায়েব সুবেদার কোয়ার্টার মাস্টার লুৎফর রহমানকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আমরা বাইরে যাচ্ছি। বাকিদেরকে ঢাকা থেকে ক্লিয়ারেন্স পেলে ছেড়ে দেয়া হবে। তবে ই-বি-আর-সির সামনে রাত্রে কোন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য থাকবে না।

 ই-বি-আর-সি থেকে বের হওয়া কষ্টকর ছিল। চারদিক থেকে এখনো এলোপাতাড়ি গোলাগুলি চলছিল। মৃত্যুকে হাতে নিয়ে বহু কষ্টে ই-বি-আর-সি এলাকা থেকে বের হতে সক্ষম হই।

 ই-বি-আর-সির বাইরে একটি ফ্লাটে আমাদের চারজন অফিসার ছিলেন। আসার পথে তাদেরকে বাইরে নিয়ে আসতে যাই। আমাকে দেখে তারা যেন আকাশ থেকে পড়ছেন বলে মনে হল। দেখার সাথে সাথে তারা