পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৬

ফেলি। ক্যাপ্টেন ফারুক পাঠান ছিল। সে খুশি হয়ে বললো। “ভালই হলো আমি তোমার অনুগত হয়ে বাংলাদেশের সেবা করবো।” রাত তখন সাড়ে এগারোটা হবে। হাজার হাজার জনতা পথে নেমেছে। আমি ই- পিআর কোম্পানীর ৪/৫ জনকে উইং হেডকোয়ার্টারের রেখে বাকী সবাইকে নিয়ে রাত সাড়ে তিনটার দিকে চট্টগ্রামের পথে রওনা হই। যাবার পূর্বে অয়ারলেস মারফত আমার অবশিষ্ট কোম্পানীগুলোকে মেসেজ পাঠাই যে, সমস্ত অবাঙ্গালীদের বন্দী করে কাপ্তাইতে একত্রিত হয়ে চট্টগ্রামের দিকে রওনা হও।

 ২৬শে মার্চ আমি যখন চট্টগ্রাম শহর থেকে ৭/৮ মাইল দুরে ছিলাম তখন দেখলাম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কয়েকজন সৈন্য পটিয়ার দিকে দৌঁড়াচ্ছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম পাক বাহিনী আক্রমণ করেছে এবং মেজর জিয়া সহ ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট বিদ্রোহ করেছে। তারা পটিয়াতে একত্রিত হবে। আমি অগ্রসর হলে মেজর জিয়ার সাক্ষাৎ পাই। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বললেন, “ক্যাপ্টেন রফিক শহরে যুদ্ধ করছে আমরা ৮ম ইস্ট বেঙ্গল পটিয়াতে একত্রিত হবো তারপর আবার শহরে এসে পাল্টা আক্রমণ চালাবো।” আমাকে তার সঙ্গে থাকতে বললেন। আমি মেজর জিয়ার সঙ্গে থেকে গেলাম। এরপর মেজর জিয়ার কমাণ্ডে কাজ করতে থাকি। পটিয়াতে আমরা সবাই মেজর জিয়ার নেতৃত্বে শপথ নেই। কালুরঘাটে পাকবাহিনী ব্যাপকভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। ১১ই এপ্রিল পাকসেনারা চারদিক থেকে বৃষ্টির মত গোলা ফেলতে থাকে।

 ঐ তারিখে আমি এবং শমসের মবিন চৌধুরী গুরুতররূপে আহত হই। আমাকে পটিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। ডাঃ নূর হোসেন (অস্ত্র বিশেষজ্ঞ) পটিয়াতে আমার অস্ত্রোপাচার করেন। তারপর আওয়ামী লীগের লোকজন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নিয়ে ফিরতে থাকে। ইতিমধ্যে কালুরঘাটের পতন ঘটে। মালুরঘাট নামক স্থানে খৃস্টান মিশনারী হাসপাতালে পুনরায় আমার অস্ত্রোপচার করে সেখান থেকে কক্সবাজারের উখিয়া নামক স্থানে সমসের আলম চৌধুরীর বাড়িতে রাখেন। সমসের আলম চৌধুরী সাহেব আমাকে ওষুধপত্র দিয়ে এবং সেবা-যত্ন করে সুস্থ করে তোলেন। ফকরুদ্দিন (আমার ব্যাটসম্যান) সব সময় সঙ্গে ছিল। খামারবাড়ি নামক স্থানে থাকা অবস্থায় পাঞ্জাবীরা আমাদের খোঁজে আসে। তখন আমাকে স্ট্রেচারে করে সবাই বার্মা চলে যায়। বার্মা রিফুইজি ক্যাম্পে সবাই আশ্রয় নিই। সেখানে চিকিৎসার পর আমি সুস্থ হয়ে উঠি। বার্মা থেকে পালিয়ে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে টেকনাফে আসি। টেকনাফে এসে বেশকিছু ই-পি-আর ছেলে পেলাম এবং তাদের সঙ্গে অন্যান্যরাও ছিল। আমি ওখানে থেকে যাই এবং আবার যুদ্ধে নেমে পড়ি।

 ১১/১২ ই ডিসেম্বর কক্সবাজারে ভারতীয় সেনাবাহিনী নামলে আমি তাদের সঙ্গে যোগ দেই এবং দেশ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাই।

স্বাক্ষরঃ হারুন আহমেদ
১৭-১-৭৫

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ক্যাপ্টেন ভূইয়া

মেজর এম, এস, এ, ভুইয়া।[১]

 ২৬শে মার্চ দুপুরে ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে আলাপের সময় আমি জানতে পারি যে, একটি বেতার- কেন্দ্র আমাদের দখলে রয়েছে। ২৮শে মার্চের সন্ধ্যা থেকে ২৯শে মার্চের রাত পর্যন্ত আমি এই বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে ছিলাম। আমার সে সময়কার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার রুপায়নই এ আলেখ্য।

 বলা বাহুল্য বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র এবং পরে মুজিবনগর থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে পরিচিত এই ঐতিহাসিক বেতার কেন্দ্রটি গোড়াতে খোলা হয়েছিল চট্টগ্রামে।


  1. ১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। বিবরণটি রচিত 'মুক্তিযুদ্ধে নয়মাস' গ্রন্থ, ঢাকা, ১৯৭৪- থেকে সংকলিত