পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৮

পুনর্গঠিত করার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবী বেতার থেকে অস্ত্র নিয়ে লালদীঘির ময়দানে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কাছে রিপোর্ট করার নির্দেশ প্রচারিত হয়েছিল। সত্বর তাদের এক জায়গায় জমায়েত করতে হলে এ ধরনের ঘোষণা প্রচার ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। বলা বাহুল্য, এই ঘোষণা এ-সময়ে বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত কয়েকজনের সাথে আলোচনা করেই প্রচারিত হয়েছিল।

 ঘোষণাটি কয়েকবার প্রচারিত হবার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য ডক্টর এ, আর, মল্লিক আমাকে টেলিফোন করেন। লালদীঘির ময়দানে একত্রিত হওয়ার এই ঘোষণা সম্পর্কে তার সাথে আমার অনেক আলাপ হয়। তিনি আমাকে অবিলম্বে এই ঘোষণা প্রচার বন্ধ করতে বলেন। তিনি যুক্তি দেন যে, এই ঘোষণামতে যদি সবাই গিয়ে লালদীঘির ময়দানে একত্রিত হয় তাহলে হানাদাররা নিশ্চয় এই জমায়েতের ওপর পি,এন,এস জাহাঙ্গীর জাহাজ থেকে শেলিং করবে, এমনকি হাওয়াই হামলাও করতে পারে। ডক্টর মল্লিকের এই যুক্তিপূর্ন উপদেশে আবার আমাকে বেতার মারফত ‘লালদীঘির ময়দানে’ একত্রিত হওয়ার ঘোষণাটি বাতিল করে দিতে হয়।

 দুনিয়ার ইতিহাসে যেসব সশস্ত্র বিপ্লব হয়েছে তাতে লক্ষ্য করা গেছে যে, প্রথমে অর্গানাইজ করা হয়েছে এবং পরে ঘোষিত হয়েছে বিদ্রোহ, হয়েছে বিপ্লব। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে ব্যাপারটি ঘটেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। এক্ষেত্রে প্রথমে ঘোষিত হয়েছে বিদ্রোহ, পরে হয়েছে সংগঠন- আমরা প্রথমে বিদ্রোহ করেছি, পরে শুরু করেছি বিদ্রোহীদের সংগঠন। ২৬শে মার্চ ভোরে যে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে তা আমরা অনেকেই ২৫শে মার্চের মধ্যরাতেও জানতাম না।

কুমিরার লড়াই[১]

মেজর এম, এস, এ ভূঁইয়া

 ইচ্ছা ছিল সন্ধ্যার আগেই ক্যাণ্টনমেণ্ট দখল করব; কিন্তু শত্রুর শক্তি বৃদ্ধির জন্যে কুমিল্লা থেকে যে ২৪নং এফ, এফ (ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স) এগিয়ে আসছে, তাকে বাঁধা দেওয়াই প্রথম কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালো।

 তখন বিকেল ৫টা। ২৪নং এফ, এফ-কে প্রতিহত করার জন্য কুমিল্লার দিকে অগ্রসর হলাম। বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আর ই-পি-আর এর মাত্র ১০২ জন যোদ্ধা সমবায়ে সংগঠিত দল নিয়ে এই অভিযানে আমরা বের হলাম। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিমা হানাদার সৈন্যদলের মোকাবিলা করার জন্যে আমাদের সম্বল মাত্র একটি এইচ-এম-জি কয়েকটি এল-এম-জি আর বাকিসব রাইফেল। এত অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে পুরো একটি সুসংগঠিত ব্যাটালিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়ার ঝুঁকি যে কি বিরাট এবং তার পরিণাম যে কি মারাত্মক হতে পারে সেদিন তা আদৌ উপলব্ধি করতে পারিনি তা নয়; আসলে মনটা ছিল তখন প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্ত: দেশের মুক্তি কামনায় উত্তপ্ত; ক্ষোভে, ক্রোধে, আবেগে উত্তেজিত। সুতরাং ঠাণ্ডা মাথায় অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা করে পরিকল্পনা করার আদৌ অবসর ছিল না তখন। অন্য কিছু সম্বল না থাকলেও যুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে জিনিসের প্রয়োজন হয় সেই সাহস, সেই উদ্দীপনা, সেই উদ্দীপ্ত প্রাণের আকাঙ্খা ছিল আমাদের সম্বল। আমাদের এই অপরিমেয় মনোবল ও দুর্জয় আত্মবিশ্বাস সেদিন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তি দিয়েছিল। এছাড়া ছিল পরম করুনাময়ের অপার করুনা যা বারবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করে আমাদেরকে সাফল্যের স্বর্ণদুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে। আজ আমার এ প্রত্যয় দৃঢ়তা লাভ করেছে যে, সত্য ও ন্যায়ের সেই পবিত্র চিরদিনই অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে এভাবেই সাহায্য করে থাকে।


  1. ‘মুক্তি যুদ্ধের' নয়মাস গ্রন্থ থেকে সংকলিত।