পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৫০

 সুবেদার সাহেব ভারী মেশিনগানটির সংগে রইলেন। কারণ এই ভারী মেশিনগানটিই আমাদের প্রধান হাতিয়ার এবং সবচেয়ে বড় সম্বল। আমি বামদিকের কয়েকটি এল-এম-জি'র পজিশন ঠিক করে দিলাম। আমার নির্দেশমত সবাই মাটিতে পজিশন নিয়ে নিল। পজিশনের অবস্থাটা হল অনেকটা ইংরেজী U (ইউ) এর মত। অর্থাৎ ডানে বায়ে এবং পিছনে আমাদের সৈন্য। যেদিক থেকে শত্রু এগিয়ে আসছে কেবল সেই সামনের দিকটা সাঁড়াশির হারের মত খোলা।

 কুমিরা পৌঁছেই মোটর সাইকেলযোগে একটি লোককে আমরা পাঠিয়েছিলাম শত্রুর অগ্রগতি সম্পর্কে খবর নিতে। এই মধ্যে সে খবর নিয়ে এসেছে যে শত্রু আমাদের অবস্থানের আর বেশী দুরে নেই। মাত্র চার পাঁচ মাইল দুরে। তবে তারা ধীরে ধীরে গাড়ী চালিয়ে আসছে। যে লোকটিকে পাঠিয়ে ছিলাম সে পাঞ্জাবীদের নিকটে গিয়ে রাস্তার পাশের একটি দোকান থেকে সিগারেট কিনে ফিরে এসেছে। সে আমাকে জানালো যে পাঞ্জাবীদের পরনে কালো বেল্ট, কাঁধে কালো ব্যাজ এবং কি যেন একটা কাঁধের উপর তাও কালো। তখন আমার সন্দেহ রইল না যে ফ্রণ্টিয়ার ফোর্সের সৈন্যরাই এগিয়ে আসছে।

 আমাদের অবস্থানের ৭০/৮০ গজ দুরে বড় একটি গাছ ছিল। জনসাধারণের সাহায্যে গাছের মোটা ডালটা কেটে রাস্তার ঠিক মাঝখানে ফেলা হলো। গাছের ডাল দিয়ে আমাদের সুন্দর একটা ব্যারিকেড সৃষ্টি হয়ে গেল। জনসাধারণ রাস্তার আশপাশ থেকে কিছু ইট এনে ইতস্তত: বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রাখল।

 এত অল্প সময়ে জনসাধারণ কিভাবে গাছের ঐ মোটা ডালটা কেটে ফেলল এবং ইট সংগ্রহ করে ব্যারিকেড সৃষ্টি করলো আজ তা ভাবতে আশ্চর্য লাগে। সৈন্যদের জানিয়ে দেওয়া হলো যে শত্রুসৈন্য যখন ব্যারিকেড সাফ করার জন্য গাড়ী থেকে নামবে এবং সাফ করার জন্য একত্রে জমা হবে তখন সকলে একযোগে শত্রুর উপর গুলি ছোড়া শুরু করবে। বিশেষ করে ভারী মেশিনগান দ্বারা অবিরাম গুলি ছুড়বে।

 প্রায় এক ঘণ্টা সময় আমাদের প্রতীক্ষার মধ্যে কেটে গেল। সন্ধা তখন ৭টা। আমরা শত্রুবাহিনীর অপেক্ষায় উৎপেতে রইলাম। আমাদের সামনে শত্রবাহিণীর উপস্থিতি প্রায় আসন্ন বলে মনে হলো। আরো কিছুক্ষণ প্রতীক্ষার পরই সম্মুখসমরে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ এলো। শত্রুবাহিনী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ব্যারিকেড দেখে সামনের গাড়ি গুলো থেমে গেল। কিছুসংখ্যক সিপাহী গাড়ী থেকে নেমে ব্যারিকেডের কাছে এলো। এবং কেউ কেউ ইটগুলো তুলে দুরে ফেলে দিতে লাগলো। পিছনের গাড়ীগুলোও তখন সেই দিকেই এগিয়ে আসছিল।

 সন্ধ্যা তখন সোয়া সাতটা। শত্রুরা যখন ব্যারিকেড সাফ করতে ব্যস্ত এমনি সময়ে আমাদের ডানদিকের ভারী মেশিনগানটি গর্জে উঠল। শুরু হল শত্রনিধন পালা। চারদিক থেকে কেবল গুলির আওয়াজই শোনা যেতে লাগল। বারী মেশিনগানটি থেকে তখন মাঝে মাঝে ট্রেসার রাউণ্ড বের হচ্ছে। উহ্ সে কি দৃশ্য। শত্রুকে এত কাছাকাছি অতর্কিত অবস্থায় পেয়ে আমার মন খুঁশিতে নেচে উঠল। মনে মনে বললাম- তোমরা (পাঞ্জাবীরা) এতদিন মনে করতে বাঙ্গালীরা যুদ্ধ করতে যানে না। এখন যুদ্ধক্ষেত্রেই বাঙ্গালীরা তোমাদেরকে জানিয়ে দেবে তারা যুদ্ধ করতে যানে কিনা। হানাদার বাহিনীর অগ্রগতি রোধ করাই ছিল আমাদের লক্ষ। আমাদের আকস্মিক আক্রমনে তারা তখন হতকচিত। তাদের সামনের সৈন্যগুলির অনেকেই আমাদের গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তাদের মৃত্যুকাতর আর্তনাদ আমাদের কানে আসছিল। যারা দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছিল তাদের তাদের অনেকেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই শত্রুদের পিছনের সৈন্যরা এ অবস্থা সামলে নিয়ে মেশিনগান, মর্টার এবং আর্টিলারি থেকে অবিশ্রাম গুলিবর্ষণ শুরু করল। এবার উভয় পক্ষে তুমুল লড়াই লেগে গেল। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও শত্রুরা আমাদের ব্যুহ ভেদ করতে পারল না। তাদের সৈন্য বোঝাই তিনটি ট্রাকে আগুন ধরে গেল। আমাদের মেশিনগান নিউট্রালাইজ করার জন্য প্রচুর পরিমানে আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপ করল। কিন্তু আল্লার মেহেরবানীতে শত্রুর সকল প্রচেষ্টা মাঠে মারা গেল। প্রায় দু'ঘণ্টা প্রানপন লড়ে তারা শেষ পর্যন্ত দুই ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রণে ভঙ্গ দিল।