পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৫৯

চট্টগ্রামে সশস্ত্র প্রতিরোধ ও প্রাসঙ্গিক কথা

॥ চরম আঘাতের সেই রাত ॥

 ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ সাল। বৃহস্পতিবার।

 অন্যান্য দিনের মতো সকাল ৭টায় আমি অফিসে গেলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি পশ্চিম পাকিস্তানী মেজর ইকবাল বসে আছেন। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, “মিঃ রফিক, আপনাকে দারুণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অনেক খাটুনি গেছে আপনার ওপর দিয়ে। কক্সবাজার গিয়ে কয়েকদিন বিশ্রাম নিন না কেন? ইচ্ছা হলে আজই যেতে পারেন। আমি কমাণ্ডিং অফিসারকে বলে দেব।”

 এটা ঠিক, গত কয়েক বছরের মধ্যে আমি কোন ছুটি নেইনি। বিশ্রামের আমার খুবই প্রয়োজন ছিলো। তবু মেজর ইকবালের সেদিনের অস্বাভাবিক পীড়াপীড়ি আমার ভালো লাগলো না, বরং আমার সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করলো। তাঁকে আমি শান্ত গলায় জবাব দিলাম, “ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু স্যার, আপনি তো জানেন গত জানুয়ারী থেকে সব ছুটি বাতিল করা হয়েছে।”

 “ওকথা বাদ দিন। আমি কমাণ্ডিং অফিসারকে বুঝিয়ে বলতে পারবো। আমার বিশ্বাস, তিনি ছুটি মঞ্জুর করবেন।” মেজর ইকবাল তবু বলে চললেন।

 মেজর ইকবাল যে কমাণ্ডিং অফিসারের একজন প্রিয়পাত্র তা আমরা সবাই জানতাম। আমাকে চট্টগ্রাম শহরের বাইরে এবং আমার সৈন্যদের সংস্পর্শ থেকে দুরে রাখার জন্যে মেজর ইকবালের এ প্রচেষ্টা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। আমি তাঁর কথায় তাল না দিয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্য বললাম, “আপনি বোধকরি জানেন, গতকাল পোর্ট এলাকায় জনতার ওপর সৈন্যরা গুলি চালিয়েছে অনেক লোক মারা গেছে।”

 “অনেক নয়’- যেন তেমন কিছুই ঘটেনি এমন ভাব দেখিয়ে তিনি বললেন, “মাত্র একজন কিংবা দু'জন আহত হয়েছে।”

 এরপর তিনি মুখে কৌতুহলোদ্দীপক হাসি ফুটিয়ে বললেন, “শুনলাম শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক পদক্ষেপের প্রতিবাদে আগামী ২৭শে মার্চ হরতাল ডেকেছেন।”

 “আমি এখনো শুনিনি তবে পোর্ট এলাকায় যে সৈন্যরা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে তার শব্দ আমাদের অফিসে বসেও শোনা গেছে।”

 সেদিন বেলা ২টায় আমি ই-পি-আর সদর দফতর ত্যাগ না করা পর্যন্ত মেজর ইকবাল সারাক্ষণ আমাকে ছায়ার মতো অনুসরন করলেন।

 ইয়াহিয়ার সাথে মীমাংসায় পৌঁছা গেছে বলে এ সময়ে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তবে নির্ভরযোগ্য কোন মহল থেকে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলো না। সরকারী বেতারে একটা রাজনৈতিক ফয়সালার আভাস দেয়া হয়। কিন্তু এ খবরের ওপরও নির্ভর করা গেলো না। বাসা থেকে সেই মুহুর্তে আমি আমার সদর দফতরে টেলিফোন করে সকল সৈন্যকে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিলাম। তারপরে বাড়ির লনে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলাম।

 চট্টগ্রামে বেল ৪টা ৩০ মিনিটের দিকে ডাঃ জাফর আমার বাসায় এলেন। লনে বসে আমরা সম্ভাব্য সবকিছু নিয়ে আলোচনা করলাম। কিন্তু তখনো ঢাকার কোন নির্ভরযোগ্য খবর আমরা পাইনি। রাত ৮টার দিকে ডাঃ

[১]


  1. মেজর (অবঃ) রফিক-উল-ইসলাম রচিত 'লক্ষ প্রানের বিনিময়ে' গ্রন্থ, ১৯৮১ থেকে সংকলিত। ১৯৭১ সালের মার্চে রফিক-উল-ইসলাম ক্যাপ্টেন পদে সাবেক ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন।