পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৬১

পাঠিয়ে দিন। অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। পাকিস্তানী সৈন্যদের রুম থেকে বের হতে দেবেন না। নৌ-বাহিনী সদর দফতরের দিক থেকে হামলা হতে পারে। সেদিকে প্রতিরক্ষামূলক কিছু সৈন্য মোতায়েনের ব্যবস্থা করুন। আমি আসছি।

 রাত তখন ৮টা ৪৫মিনিট। আমি শেষবারের মত আমার সারসন রোডস্থ বাসভবন ত্যাগ করলাম। আমাদের প্রথম লক্ষস্থল অয়্যারলেস কলোনীর দিকে আমাদের গাড়ী ছুটে চললো। আমার পাশে ড্রাইভার কালাম এবং পেছনের সিটে দুজন রক্ষী। তীব্র উত্তেজনায় সবাই ঠোঁট কামড়াচ্ছিলো। রাস্তা জনমানবশূণ্য। আমাদের গাড়ী যতই অয়্যারলেস কলোনীর কাছাকাছি এগোচ্ছিলো, উত্তেজনা ততই বাড়ছিলো। একটা সরু রেল ক্রসিংয়ের ওপর আসতেই জীপ একটু লাফিয়ে উঠলে আমার চিন্তায় ছেদ পড়লো। আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। এখান থেকে আমি অয়্যারলেস স্টেশনের এ্যানটিনা দেখতে পাচ্ছিলাম। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসাবে আয়্যারলেস স্টেশনের চারদিক ছিল কাটা তারে ঘেরা। যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে সেজন্য আমি ড্রাইভারকে গাড়ী আস্তে চালাতে বললাম। আমাদের এখানকার সাফল্য ছিলো অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যান্তরীণ নিরাপত্তামূলক ডিউটিতে নিযুক্ত ই-পি-আর-এর একটি প্লাটুনের মোকাবিলা করতে হবে আমাদের ৪ জনকে ওদেরকে নিরস্ত্র করতে হবে। আমার রেকর্ড অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন হায়াত এবং সুবেদার হাসমত এই প্লাটুনের কমাণ্ডে ছিলেন। বাকী সেনারা সবাই ছিলো বাঙ্গালী। আমাদের জানামতে এখানে আরো তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ছিলো। অনুরুপভাবে নগরীর অন্যান্য এলাকাতেও ই-পি-আর প্লাটুন অবস্থান করছিলো। তবে অয়্যারলেস কলোনীর এই প্লাটুনটিই শুধু পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারের কমাণ্ডে ডিউটিরত ছিলো।

 গেটে পৌঁছতেই প্রহরারত শাস্ত্রী জীপ থামিয়ে দিলো। বাঙ্গালী শাস্ত্রী প্রহরারত ছিলো। সে আমার জীপটি ভেতরে যাবার অনুমতি দিলো। আমরা ক্যাপ্টেন হায়াতের রুমের সামনে গিয়ে জীপ থামালাম। সেখানেও একজন শাস্ত্রী পাহারা দিচ্ছিলো।

 সাবধানে আমি হায়াতের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলাম। কয়েক মূহুর্তের মধ্যে মারাত্মক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, হয় সফল হবো, না হয় আমার মাথা ভেদ করে একটা বুলেট বেরিয়ে যাবে। শেষেরটি সত্যি হলে চট্টগ্রামের ই-পি-আর সেনা পরিচালনা করতে আর কোন বাঙ্গালী অফিসার থাকবে না। এই চিন্তা আমাকে কিছুটা বিহবল করে তুললো ক্ষণিকের জন্য।

 আমি খুব আস্তে দরজায় নক করলাম এবং বন্ধুসুলভ গলায় বললাম, “হ্যালো হায়াত ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি?”

 এই কেবল শুয়েছি স্যার। আমার গলার স্বর চিনতে পেরে সে আলো জ্বালালো। জানালার পর্দার ফাক দিয়ে আমি দেখলাম বালিশের তলা থেকে কি যেন একটা নিয়ে সে তার শোবার পোশাকের নিচে রাখছে। দরজা খোলার অপেক্ষায় দাড়িয়ে আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো।”

 “সব ঠিকঠাক হ্যায়” জবাব দিয়েই সে দরজা খুললো।

 “প্লিজ ভেতরে আসুন স্যার, এবং “

 তার কথা শেষ না হতেই আমি ষ্টেনগান তার বুকের ওর ধরে বললাম, আমি দুঃখিত হায়াত, তোমাকে গ্রেফতার করতে হচ্ছে। হঠাৎ সে তার পিস্তল বের করার উদ্যোগ নিতেই ড্রাইভার কালাম দ্রুত এগিয়ে আসে এবং দুজনেই হায়াতের মাথায় আঘাত করি। সাথে সাথে আমরা তার হাত ও মুখ বেধে ফেললাম এবং টেলিফোনের তার কেটে দিলাম। তারপর পাশের ব্যারাকে ঘুমন্ত সুবেদার হাসমতকে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠালাম। সুবেদার হাসমত চোখ মুছতে মুছতে উঠে এসে স্যালুট দিয়ে দাড়াতেই কালাম এবং অন্য প্রাহরীরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হাসমতকে আটক করে তার হাত ও মুখ বেঁধে ফেলা হলো।