পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৬২

 হায়াতের রুমের সামনে দাড়ানো শাস্ত্রীটি এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে এইসব অদ্ভুত ঘটনা দেখছিল। হঠাৎ কি মনে করে সে একটি টিলার দিকে দৌঁড় দিলো। কালাম ফিসফিস কণ্ঠে বললে, ও পশ্চিম পাকিস্তানী এবং পর মূহুর্তেই একটি বুলেট সাঁ করে চলে গেলো। আমরা নীচু হয়ে বসে পড়লাম। ব্যারাকগুলো থেকে সৈন্যরা বেরিয়ে পড়তে লাগলো। যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় আমি বললাম, শাস্ত্রী ভুল করে গুলি ছুঁড়েছে। তারপর সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাড়ানোর নির্দেশ দিলাম। অন্য তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পন করলো। যে শাস্ত্রী গুলি ছুড়েছিলো সে অস্ত্র ফেলে পালিয়ে গেলো। এই প্লাটুন থেকে আমি ১০ জন সেনাকে রেলওয়ে হিলে আমার সম্ভাব্য সমর-দফতর রক্ষা করার জন্য পাঠালাম। অন্যদেরকে হালিশহরে আমার সঙ্গে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিলাম। বিচ্ছিন্ন প্লাটুনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বিভিন্ন দিকে কয়েকজন বার্তাবাহককে পাঠালাম এবং চূড়ান্ত নির্দেশের জন্য সবাইকে অবিলম্বে হালিশহরে আমার সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দিলাম।

 অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে একটি দুঃসাধ্য কাজ সমাধা হলো। ড্রাইভার কালাম এবং দুজন প্রহরীকে ধন্যবাদ, তারা জীবন বিপন্ন করে এ কাজে সহায়তা করেছে।

 রাত সাড়ে নটায় আমরা হালিশহরে পৌঁছলাম। ড্রাইভার কালামকে সতর্ক করে আলো নিভিয়ে দিয়ে গাড়ী আস্তে চালাবার নির্দেশ দিলাম। হালিশহরে জেসিও এবং এনসিওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। তিনটি অস্ত্রাগাড়ের সবকটিই অমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিলো। বাঙ্গালী সেনারা যার যার অস্ত্রাগারের সামনে অস্ত্র ও গুলির জন্য সমবেত হয়েছে। মাত্র একমাস আগে আমরা থ্রি নট থ্রি রাইফেলের পরিবর্তে বিপুল পরিমান চীনা হাতিয়ার ও গোলাগুলি পেয়েছিলাম। এগুলো মিলিয়ে আমাদের মজুত ছিলো উদ্বৃত্ত, যা পরে খুবই কাজে লেগেছিলো।

 হালিশহরের কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ন। এখানে ছিল প্রায় ৩০০ পশ্চিম পাকিস্তানী-ই-পি-আর সৈন্য। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলো সিনিয়র জেসিও এবং এনসিও। নিঃশব্দে এদের পরাভুত করতে হবে কেননা আমার সদর দফতরের চারপাশের এলাকায় ছিলো অবাঙ্গালীদের ঘন বসতি। এছাড়া বেশ কিছুসংখ্যক কমাণ্ডো সেসব অবাঙ্গালীর সঙ্গে বসবাস করছে বলে আগেই খবর পেয়েছিলাম এবং কমাণ্ডো ও অবাঙ্গালীরা সবাই ছিলো পুরোপুরি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। কাজেই এখানে কোন শব্দ হলে গোটা ব্যাপারটা পণ্ড হয়ে যাবে।

 অস্ত্রাগার আমাদের কব্জায় থাকায় আমরা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলাম। শুধু একটি মাত্র বিপদ ছিলো, কেউ যদি গোপনিয়তা ফাঁস করে দেয় তাহলে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে কিংবা নৌবাহিনী সদর দফতর থেকে পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের প্রচেষ্টা বানচাল করতে ছুটে আসতে পারে।

 আমরা প্রথমে সমগ্র এলাকা ঘেরাও করে ফেললাম যাতে কোন পশ্চিম পাকিস্তানী পালাতে না পারে। এরপর শুরু হলো শত্রুসৈন্যদের গ্রেফতারের পালা।

 মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে অনেক বাঙ্গালী জেসিও এবং এনসিওকে সীমান্ত এলাকায় পাঠিয়ে চট্টগ্রামের ই-পি-আর সদর দফতরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের মোতায়েন করা হয়েছিলো। চট্টগ্রামের ই-পি-আর কমাণ্ডার ছিলেন লেঃ কর্নেল আবদুল আজিজ শেখ। নিজেদের অবস্থান সুদৃড় করার জন্য ঢাকার নির্দেশে তিনি এই ব্যবস্থা করছিলেন।

 এইসব বদলী ইত্যাদির ব্যাপারে প্রথমে আমি খুবই চিন্তিত হয়েছিলাম। পরে দেখলাম যে, এটা আমার পরোক্ষ উপকারেই লেগেছে। কারণ, এক জায়গায় এতগুলো শত্রুসৈন্য পাওয়া কম সৌভাগ্যের কথা নয়।

 আমি কৌশলে অস্ত্রাগারে বাঙ্গালীদের মোতায়েন রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম। দিনের বেলা আমি শুধু বাঙ্গালী সেনাদের চুলকাটা, পোশাক ও আচরণ পরীক্ষা করে দেখতাম। এদেরকে সংশোধনের অছিলায় শাস্তি হিসাবে অস্ত্রাগার প্রহরার অতিরিক্ত ডিউটি দিতাম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাতের এই ডিউটি পড়তো। ফলে অস্ত্রাগারের কাছে আর কোন পশ্চিম পাকিস্তানীর থাকার দরকার হতো না। আমার এই ব্যবস্থা খুবই কাজে লেগেছিলো।