পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৬৩

তখন রাত ১০টা। আমি আমার অফিসের বারান্দায় অস্থিরভাবে পায়চারি করছি। ভীষণ ক্ষুধা বোধ করছিলাম। উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। পানি পর পর দুগ্লাস খেয়ে দেখলাম। সৈন্যদের ইতিমধ্যে অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়ে গেলো। নৌ-বাহিনীর সদর দফতর থেকে কোন হামলা হলে তা প্রতিরোধ করার জন্য দুটি প্লাটুন এর মধ্যেই সেদিকে পাঠানো হয়েছিলো। আমি পশ্চিম পাকিস্তানি সবচাইতে সিনিয়র জেসিও সুবেদার মেজর ইতবার-এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

 কোনরূপ সন্দেহ না করেই সুবেদার মেজর আমার অফিস রুমে প্রবেশ করলেন। আমি তাকে বসতে বললাম। তারপর বললাম, “সুবেদার মেজর সাহেব, আপনি তো ঘুমাচ্ছিলেন। শহরে কি ঘটেছে জানেন কিছু?”

 “না স্যার”- সরলভাবেই তিনি জবাব দিলেন। আসলেও তিনি কিছু জানতেন না। তিনি শুধু দেখছেন যে, সৈন্যরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে এবং তিনি এটাকে আমার নেতৃত্বে অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা ডিউটির অঙ্গ বলে মনে করেছিলেন। পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ গণহত্যা পরিকল্পনার কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করায় ব্রিগেডিয়ারের নিচের পদের খুব কমই এ ব্যাপারে জানতে পারে। মাত্র কয়েকজন লেফটেন্যাণ্ট কর্নেল এ ব্যাপারে জানতে পেরেছিলেন। এ কড়াকড়ি গোপনিয়তা প্রকারান্তরে আমাদেরই কাজে লেগেছিলো।

 সুবেদার মেজর হঠাৎ চোখ কচলে দেখলেন পাশের বিশ্রাম কক্ষ থেকে চারজন সৈন্য বেরিয়ে এসে রাইফেলের বেয়োনেট তাঁর বুকের ওপর ধরেছে। আমি তখন দৃড়কণ্ঠে বললাম, “সুবেদার মেজর সাহেব, আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। চীৎকার কিংবা পালাবার চেষ্টা করলেই প্রাণ হারাবেন।”

 তাঁর হাত বেধে বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। এভাবেই অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সকল পশ্চিম পাকিস্তানী জেসিওকে গ্রেফতারের পালা শেষ হলো। এ গোপনীয়তা রক্ষা না করলে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যেতো। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান সুদৃড় হবার আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিংবা নৌবাহিনীর লোকেরা আমাদের আক্রমণ করে বসতো।

 এর কিছু পরেই ই-পি-আর সিগন্যাল কোম্পানীর দায়িত্বে নিয়োজিত অবাঙ্গালী জেসিও সুবেদার মোবিনকে আমার কক্ষে ডাকলাম। ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী ই-পি-আর সেনারা কিছু একটা ঘটেছে বলে আচ করে ফেলে। কিন্তু নিরস্ত্র অবস্থায় তাদের আর কিছু করার ছিলো না। কেননা, গোটা এলাকা আমাদের সৈন্যরা আগেই ঘেরাও করে ফেলেছিলোঃ

 সুবেদার অফিসে ঢুকতেই দেখি সে খুব অতঙ্কিত। ঠিক এ সময়ে মেজর ইকবালের টেলিফোন এলো। আমি রিসিভার তুলে ধরতেই ওপাশ থেকে তিনি বললেন, হ্যালো রফিক এতো রাতে ওখানে কি করছেন?

 “এখানকার গার্ডরা সতর্ক আছে কিনা, দেখতে এসেছি।”

 “আচ্ছা। মুহুর্তের জন্য তিনি থামেন, তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করেন, সুবেদার মোবিন কোথায়?”

 “তিনি হয়তো রুমে ঘুমাচ্ছেন। কথা বলবেন তাঁর সাথে?”

 “হ্যা, দয়া করে টেলিফোনটা তাকে দিন না।”

 “আমি এক্ষুনি তার কাছে লোক পাঠাচ্ছি। তিনি এলেই আপনাকে ফোন করতে বলবো।” সন্দেহ নিরসনের জন্য আমি আরো কিছুক্ষন তার সাথে আলাপ চালিয়ে যাই, সৈন্যরা ডিউটি দিচ্ছে কিনা তা কয়েকটি জায়গায় দেখে এসেছি, সবকিছু ঠিক আছে।”

 এরপর হঠাৎ তার প্রশ্ন শুনে ধাক্কা খেলাম। “কিন্তু ক্যাপ্টেন হায়াতের টেলিফোন কেউ ধরছে না কেন?”