পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৬৬

 ইতিমধ্যে রেলওয়ে হিলে প্রতিরক্ষায় আমার ই-পি-আর প্লাটুনগুলোকে সুসংগঠিত করে যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে এই পাহাড়েরই একটিন আবাসিক ভবনের নিচতলায় আমার সদর দফতর স্থাপন করলাম।

 এই ভবনে রেলওয়ে অফিসারদের কয়েকটি পরিবার বাস করতেন। রেলওয়ে হিলে অবস্থান নিতেই সেখানকার অফিসার এবং তাদের পরিবারবর্গ অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। তারা গাড়ি থেকে আমাদের জিনিসপত্র নামাতে পাহাড়ের উপর আত্মরাক্ষামুলক ট্রেঞ্চ খুড়তে, নতুন টেলিফোন লাইন স্থাপন করতে এবং আমাদের সৈনিকদের খাবার তৈরীতে প্রভূত সাহায্য করেন।

 আগেই কোথায় কোথায় ট্রেঞ্চ খুড়তে হবে তা দেখে রেখেছিলাম এবং কয়েকজন জেসিওকে স্থানগুলো গোপনে দেখিয়েছিলাম। সৈনিকরা যথাস্থানে ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে কিনা তা দেখার জন্য রেলওয়ে হিলের চারদিক ঘুরলাম। পূর্বনির্ধারিত পাহাড়ের ঢালে ৩ ইঞ্চি মর্টার স্থাপন করা হলো। রেলওয়ে হিলে আরও কয়েকটি ভবনে বহুসংখ্যক অফিসার তাদের পরিবারবর্গকে অন্য কোন নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানালাম। আমাদের কথামত অফিসারদের পরিবারবর্গকে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হলেও অধিকাংশ রেলওয়ে অফিসার এবং তাদের বয়স্ক পুত্রসন্তান ও পুরুষ আত্মীয়রা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের সাহায্য করার জন্য পাহাড়েই থেকে গেলেন। ইতিপূর্বে খবর পেয়েছিলাম চট্টগ্রামের সকল সীমান্তবর্তী ফাড়ির ই-পি-আর সৈনিকরা অবাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করে আমার সঙ্গে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে কেবলমাত্র নৌ-সদর দফতর এবং সেনানিবাস ছাড়া সমগ্র চট্টগ্রাম শহর এলাকা, হালিশহরস্থ ই-পি-আর লাইন এবং ই-পি-আর সদর দফতর তখন আমাদের পূর্ন নিয়ন্ত্রনে। আমি ভেবেছিলাম ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের সৈনিকদের নিয়ে মেজর জিয়া এবং লেঃ কর্নেল চৌধুরী সেনানিবাস আক্রমণ করবেন এবং আক্রমণে নিশ্চয়ই তারা সফলতা অর্জন করবেন। পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কাযক্রম গ্রহণের উদ্দেশ্যে রাত ৮টা ৩০ মিনিটে যখন আমি সারসন রোডের বাসভবন ত্যাগ করি তখনই ডাঃ জাফর এবং জনাব কায়সারকে বলেছিলাম ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে তারা যেন খবরটি জানিয়ে দেন। তারা আমার যুদ্ধ শুরু করার কথা এই রেজিমেণ্টকে জানিয়েছিলেন। বলা প্রয়োজন যে, ঐ রাতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে হালিশহর এবং চট্টগ্রাম নগরীর অন্যান্য এলাকার ৫০০ অবাঙ্গালী সৈনিক, জেসিও এবং কয়েকজন ই-পি-আর অফিসারকে আমরা নিরস্ত্র করতে পেরেছিলাম। আমার অধীনস্থ ই-পি-আর সৈনিক ও জেসিওদের সাহসিকাপূর্ণ কার্যক্রমের পূর্ণ গোপনীয়তা সুষ্ঠু পরিকল্পনার জন্যই অবাঙ্গালী সৈনিক ও অফিসারদের নিরস্ত্র করা সম্ভব হয়েছিলো।

 প্রাথমিক সাফল্যের পর রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে দিকে আমি ৮ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টারের সৈনিকদের সাফল্যের খবর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম আর ভাবছিলাম নিশ্চয়ই তারাও ২০ বালুচ রেজিমেণ্টাক ইতিমধ্যে নিরস্ত্র করতে পেরেছেন। প্রথমিক সাফল্যের পর পরই সদর দফতর এবং বিমানবন্দর দখলের জন্যে আমি আমার সীমান্ত ফাঁড়ির ই-পি-আর সৈনিকদের আগমন অপেক্ষায় উন্মুখ ছিলাম।

 ইত্যবসরে আমি বেতার কেন্দ্র, টেলিফোন একচেঞ্জ আক্রমণ ও দখল করার উদ্দেশ্যে আমার সৈন্যদের পাঠালাম। আমার এই রেলওয়ে হিল দফতরের ঠিক উল্টোদিকেই ছিলো নৌ-বাহিনীর যোগাযোগ কেন্দ্র। এখান থেকে পরিস্কার দেখা গেলো কয়েকজন পাকিস্তানী নৌ-সেনা ওখানে ঘোরাফেরা করছে। ঠিক এই সময়ে নৌ-বাহিনীর একটি গাড়ি আগ্রাবাদের দিকে এগিয়ে গেলো। আমার মর্টার জেসিও সুবেদার আইজুদ্দিন গাড়ি দেখেই তাঁর অবস্থান থেকে দৌড়ে এসে বললো, “স্যার, গাড়িতে কয়েকজন নৌ-সেনা রয়েছে। দেবো নাকি শেষ করে?”