পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৭৩

দিলাম। আমাদের আশা ছিলো সেখান থেকে ক্যাণ্টনমেণ্টের ওপর আক্রমন চালিয়ে ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে প্রচুর গোলাগুলি উদ্ধার করতে পারবো।

 আমাদের ভিন্ন রাস্তায় অগ্রসর হতে হলো। ক্যাণ্টনমেণ্ট ও শহরের মধ্যবর্তী প্রধান শহরটি তখন শত্রুকবলিত। আমরা কিছু লোক গাড়িতে এবং কিছু লোক পায়ে হেটে গন্তব্যস্থলের দিকে রওয়ানা হলাম। চকবাজারের কিছু সামনে শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছতেই দেখলাম আমার একজন ইপিআর সিপাই পায়ে হেটে শহরের দিকে ফিরছে। ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? আমি চীৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম। বিষন্ন কণ্ঠে সে জবাব দিলো আপনার কাছেই স্যার। সে আরো বললো, আপনি ক্যাণ্টনমেণ্টের পেছনের এলাকায় গিয়ে আমাদের একত্র হওয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু একজন অফিসার অন্যপথ দিয়ে সৈন্যদেরকে নিয়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে চলে গেছেন। আমি আবার চীৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম। কোন অফিসার?

 “আমি তার নাম জানি না স্যার।”

 জনাব হান্নান এবং ডাঃ জাফরকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম মেজর জিয়াউর রহমান আমাদের সেনাদের কালুরঘাট সেতুর দিকে নিয়ে গিয়েছেন। আমি আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুরোধ করলাম তারা যেন জিয়াকে বলেন, আমার সৈন্যদের ছেড়ে দিতে যাতে ওরা শহরে আমার সাথে যোগ দিতে পারে। তদনুসারে ডাঃ জাফর, জানাব হান্নান, নগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জনাব মান্নান, জানাব কায়সার এবং আরো কয়েকজন কালূরঘাটের দিকে রওয়ানা হয়ে যান। গোমদণ্ডী স্টেশনের কাছে তারা মেজর জিয়া, মেজর শওকত এবং অন্য কয়েকজন অফিসারের সাক্ষাৎ পান। আমার সাথে শহরের লড়াইয়ে অংশ নেয়ার জন্য তারা জিয়াকে আমার সৈন্যদের ছেরে দিতে বলেন। মেজর জিয়া জবাব দেন যে, তার সেনাবাহিনী পূনর্গঠননের পরই তিনি আমার সংগে যোগ দেবেন। আওয়ামী লীগ নেতারা ফিরে এসে আমাকে সব কথা জানালেন। অবশ্য মেজর জিয়া এবং তার সংগের অন্য অফিসাররা শহরের লড়াইয়ে আর আসতে পারেন নি।

 ঢাকা থেকে তখনও বিমান বোঝাই করে সৈন্য আনা হচ্ছিলো। প্রধানতঃ কুমিল্লার ৫৩ বিগ্রেড থেকে এবং অন্যান্য স্থান থেকেও পাক সৈন্যরা চট্টগ্রামের পথে এগিয়ে আসছিলো। শহরের ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছিলো। এদিকে বাংলাদেশের পতাকার বিক্রি বেড়ে গেলো বহুগুণ। সর্বত্র নীল আকাশের নিচে নতুন জাতীয় পতাকা উড়তে দেখা গেলো। কিন্তু ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে শত্রুসৈন্যরা বেরিয়ে সবাইকে সেগুলো নামিয়ে ফেলতে বাধ্য করতে লাগলো। যদিও প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে গ্রথিত বাংলাদেশের পতাকার ছাপ তারা কোন দিনই মুছে ফেলতে পারেনি।

 ক্যাণ্টনমেণ্টের অদূরে ইপি-আর সৈন্যরা আমার কথা অনুযায়ী নতুন সৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমার সৈন্যদের কালুরঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ কথা তারা তখনো জানতে পারেনি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে ক্যাণ্টনমেণ্টের ওপর যে হামলা পারিচালনার পরিকল্পনা আমি ইতিপূর্বে করেছিলাম তা ভেস্তে গেলো।

 এমতাবস্থায় আমি অস্ত্র এবং গোলাবারুদের জন্যে ভারতে যাবার নিদ্ধান্ত নিলাম। ভাবলাম, ৬০ মাইল পথ অতিক্রম করে ভারতে একবার যেতে পারলে সেখান থেকে নিশ্চয়ই অস্ত্র, গোলাগুলি এবং জরুরী জিনিসপত্র সংগ্রহ করা যাবে এবং এরপর রামগড় থেকে কিছু সৈন্য নিয়ে এসে ক্যাণ্টনমেণ্ট আক্রমন করতে পারবো। অস্ত্রের জন্য ভারতে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে আমি সীমান্ত রক্ষীদের সাথে প্রাথমিকভাবে আলোচনা করে রাখার জন্য অয়্যারলেসে রামগড়ে একটি বার্তা পাঠালাম। আমার ভারত পৌঁছানোর পর আলোচনা শুরু করতে যাতে দেরি না হয় সেজনই আগে থেকে এ ব্যবস্থা করলাম।