পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৭৪

॥ সরবরাহের অভাব ॥

 ২৮শে মার্চ ভোর নাগাদ শত্রুপক্ষ ক্যাণ্টনমেণ্ট এবং নৌ-বাহিনীর ঘাটির মধ্যবর্তী প্রধান সড়কের টাইগার পাস এলাকা দখল করে নেয় এবং নগরীর কেন্দ্রস্থলে সার্কিট হাউসে তাদের সদর দফতর স্থাপন করে। কুমিরায় যে শত্রুদলটিকে আমরা প্রতিহত করেছিলাম তারাও এসে ক্যাণ্টনমেণ্টের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। আমাদের সেখানকার সৈন্যরা সরে এসে হালিশহরের প্রধান প্রতিরক্ষাব্যূহে অবস্থান নেয়। হালিশহরে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ দু'ভাবে কাজে লাগছিলো। প্রথমত, এই প্রতিরক্ষা ছিল বিমানবন্দর, নৌ- বাহিনীর সদর দফতর এবং পোর্ট এলাকায় শত্রুদের জন্য আসার পথে হুমকিস্বরুপ। দ্বিতীয়ত, শত্রুদের প্রধান অংশে আঘাত পরিচালনার জন্যও দৃঢ় ঘাঁটি হিসেবে এটা কাজে লাগছিলো। পথিমধ্যে ইপি-আর সৈনিকদের কালুরঘাটে আটকানো না হলে পোর্ট, বিমানবন্দর এবং নৌ-বাহিনীর সদর দফতর আক্রমন এবং দখল করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো এবং তাহলেই যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যেতো। পোর্ট এলাকা থেকে শত্রু সৈন্যরা দিনের বেলায় কয়েকবারই আগ্রাবাদ রোড পরিস্কার করে টাইগার পাস দিয়ে নৌ-ঘাঁটির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে। কিন্তু তীব্র প্রতিরোধের মুখে প্রত্যেকবারই তাদের পিছু হটতে হয়। শত্রুরা হয়তো মরিয়া হয়ে অগ্রসর হলে সড়কটি দখল করতে পারতো। কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় এই ধরনের সংঘর্ষে লোকক্ষয় ছিলো অবশ্যম্ভাবী। লোকক্ষয় এড়ানোর জন্যেই তারা সাময়িকভাবে এই প্রচেষ্টা স্থগিত রেখে কুমিল্লা থেকে অগ্রসরমান সৈন্যদের দেওয়ান হাট উপস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

 দামপাড়া পুলিশ লাইনের বাঙালী পুলিশরাও অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শত্রু সৈন্যদের প্রতিরোধ করছিলো। কিন্তু যুদ্ধের পুরো ট্রেনিং এবং অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা বেশীক্ষণ টিকতে পারেনি। সংঘর্ষে বহু বাঙালী পুলিশ হতাহত হয়। শত্রুদের ক্রমাগত চাপের মুখে বাঙালী পুলিশদের স্থানটি পরিত্যাগ করতে হয়।

 পরদিন ২৯শে মার্চ। সকালে শত্রুসেনারা আগ্রাবাদ রোড অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এবং একটি দলকে তারা মাদারবাড়ী ও আইস ফ্যাক্টরী সড়ক হয়ে নিউ মার্কেটের দিকে পাঠিয়ে দেয়। নিউমার্কেটে অবশ্য আমাদের লোক ছিলো না তকে আমি এক প্লাটুন শক্তিসম্পন্ন একটি দলকে (প্রায় ৩০জন) ঐ এলাকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান কোর্ট ভবন দখলে রাখার জন্য পাঠিয়েছিলাম।

 শত্রুদের আরেকটি দল ষ্টেডিয়ামের বিপরীত দিকের নৌ-ভবন থেকে বেরিয়ে পি, আই, এ অফিসের নিকটবর্তী একটি লেনের মধ্য দিয়ে ডিসি হিলের দিকে এগোতে থাকে। কয়েকজন পথচারী তাদের সামনে পড়লে পাকিস্তানীরা তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর একস্থানে থেমে তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় এবং দ্রুতগতিতে পাহাড়ের উপর উঠে সমগ্র এলাকাটি বিনা বাধায় দখল করে নেয়। কোর্ট বিল্ডিং-এ তখন আমাদের সৈন্যরা পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য অপেক্ষমান। তারা গভীরভাবে সাহায্যের প্রত্যাশা করছিলো। এবং সাহায্য করলেই যে কোন মূল্যে তারা শত্রুদের প্রতিরোধ করতে পারতো।

 এইদিন বিকালে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি জাকির হোসেন রোডে একটি এ্যাম্বুলেন্স পাঠাবার জন্য মেডিকেল কলেজে ফোন করে। এ পর্যন্ত মেডিকেল কলেজ আমাদের সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রনে ছিলো। কলেজের নিকটেই গুরুত্বপূর্ন স্থান প্রবর্তক হিলে আমাদের কিছু সৈনিক মোতায়েন ছিলো। আমাদের আহত সৈনিকদের নিয়ে মেডিকেল কলেজের ডাক্তার, নার্স এবং ছাত্রছাত্রীরা সকলেই দিনরাত ব্যস্ত ছিল।

 পূর্ব কথিত এ্যাম্বুলেন্সটি ফিরে আসতেই ডাক্তার এবং নার্সরা দ্রুত বেরিয়ে আসেন। কিন্তু এ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলতেই বেরিয়ে আসে একদল শত্রুসৈন্য, হাতে তাদের উদ্যত হাতিয়ার। ক্ষিপ্ততার সাথে তারা হাসপাতাল ভবনের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। সন্ধা নাগাদ আরো একদল শত্রু সৈন্য এসে অবস্থান রত সৈনিকদের সাথে যোগ দেয়। কর্মচঞ্চল হাসপাতাল ভবন এবং পার্শ্ববর্তী আবাসিক এলাকায় নেমে আসে এক বিষণ্ণ নীরবতা।