পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৭৭

 আমি গোলক মজুমদারকে বললাম ক্যাসেট যদি পাঠিয়ে থাকেন, প্রচার করে দিন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই একটি মাত্র সিদ্ধান্ত এককভাবে নিয়েছিলাম। এই দিন ছিল দশই এপ্রিল। রেডিও অন করে রেখে খেতে বসেছি। খাওয়ার টেবিলে তাজউদ্দিন ভাই ও শেখ মনি আছেন। রাত তখন সাড়ে ন’টা সেই আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত আসলো। প্রথমে আমার কণ্ঠ ভেসে আসলো। ঘোষণায় আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এখন বক্তৃতা দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা প্রচারিত হল। সারা বিশ্ববাসী শুনলো স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার বক্তৃতা। আমাদের সংগ্রামের কথা দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়লো।

 বক্তৃতা প্রচারিত হলো। আমাদের তিনজনের কারো মুখে কোন কথা নেই। আমি শুধু বললাম, গোলক মজুমদার শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা প্রচার বন্ধ করতে পারেননি। মনসুর ভাই রুটি খেয়ে আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তিনি বক্তৃতা শুনতে পাননি।

 পরে একক সিদ্ধান্তে বক্তৃতা প্রচারের জন্য তাজউদ্দিন ভাই-এর কাছে ক্ষমা ও শাস্তি প্রার্থনা করি। তিনি বলেছিলেন যে, সে সময় আমার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। সেদিন বক্তৃতা প্রচার না করলে গোলমাল আরো বৃদ্ধি পেত বৈকি।

 শেখ মনি তাজউদ্দিন ভাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে তিনি আগারতলা গিয়ে সকল প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু আগরতলা গিয়ে শেখ মনি ভারত সীমান্তের কাছাকাছি কসবাতে সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের বাড়িতে চলে যান।

 তাজউদ্দিন ভাই-এর বক্তৃতা প্রচারের পর অনেক রাতে কর্নেল (অবঃ) নুরুজ্জামান (সেক্টর কমাণ্ডার) ও আবদুর রউফ (রংপুর) আসেন। গভীর রাত পর্যন্ত তাদের সাথে আলোচনা করি। উত্তর বঙ্গে কয়েকটা সেক্টর রয়েছে। একটা সেক্টরের দায়িত্বে রয়েছেন কর্নেল জামান। তারা জানান, গেরিলা কায়দায় আকস্মিক হামলায় শত্রুদের পর্যুদস্ত করা হচ্ছে।

 আমি অবাঙ্গালীদের ওপর হামলা না করার পরামর্শ দিলাম। অবাঙ্গালী বিহারীদের ওপর জনগণ ক্ষুদ্ধ। রংপুর ও সৈয়দপুরে বেশ কিছু বিহারী রয়েছে। অবশ্য ইতিমধ্যে কোন কোন স্থানে এদের ওপর বিচ্ছিন্ন হামলা হয়ে গেছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব হামলা বন্ধ করার চেষ্টা করছে। অবশ্য অবস্থা অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে।

 আলোচনা করতে করতে রাত প্রায় ভোর হয়ে গেল। ভোরের দিকে তাঁরা দু’জন চলে গেলেন। তাদের অনেক কাজ। এক মুহূর্ত সময় নেই। যোদ্ধারা তাদের নির্দেশের অপেক্ষা করছেন। সরকার গঠনে তারা আনন্দ প্রকাশ করলেন।

 পরদিন ১১ই এপ্রিল সকালে নাশতা করে আমরা বিমানে উঠি। আগের রাতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পর থেকেই শেখ মনি চুপচাপ রয়েছেন। বক্তৃতার কথা শুনে মনসুর ভাই উৎফুল্ল। রাতের বিশ্রামের পর মনসুর ভাই কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

 যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত মনসুর ভাই অবিশ্রান্তভাবে কাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিতর্কের অবসান হওয়ায় মনসুর ভাই যেন বেশি খুশী।

 খুব নিচু দিয়ে আমাদের ছোট বিমান উড়ছে। দু“দেশের নেতাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বিশেষভাবে খোঁজ করার জন্য ময়মনসিংহ সীমান্তে আমরা খবর দিয়ে রেখেছিলাম। সৈয়দ নজরুলকে পাওয়া যেতে পারে এমন একটি স্থানে গিয়ে প্রথমে শুনলাম, নেতৃত্বস্থানীয় কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে বিএসএফ-এর স্থানীয় অফিসার জানান, ঢালু পাহাড়ের নীচে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নান রয়েছেন। এ কথা শুনে আমরা ‘ইউরেকা’ বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠি।