পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৭৮

 প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে তাঁরা দু’জন আসলেন। নজরুল ভাই জীপ থেকে প্রথমে নামেন। আমার সহকারী হুইপ আবদুল মান্নানকে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে জানলাম ২৫শে মার্চের পর থেকে মান্নান সাহেব খুব কষ্টে দিনকাল কাটিয়েছেন। পাক বাহিনীর ভয়ে দু’দিন পায়খানায় পালিয়ে ছিলেন। টাঙ্গাইল থেকে সড়ক পথে হেঁটে ময়মনসিংহ এসেছেন। তিনি একেবারে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছেন।

 সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। আমাদের খবর পেয়ে নজরুল ভাই ও তার ভাই যথেষ্ট উৎসাহিত হন। নজরুল ভাইকে তাজউদ্দিন ভাই ডেকে নিয়ে একান্তে কথা বলেন। গত কয়েক দিনের ঘটনাবলী তাকে অবহিত করা হয়। আমরা বাইরে বসে আছি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোবারকবাদ জানান। এই দৃশ্য দেখে আমরা সকলেই উৎফুল্ল হই। আমরা আবার বিমানে উঠি। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল আগরতলা। আমরা বিমানে আসন গ্রহণ করি। সামনের আসনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মনসুর ভাই। নজরুল ভাই বিমানে বসে ঢাকা থেকে পলায়নের কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি ডাঃ আলীম চৌধুরীর ছোট ভাই-এর বাসায় থাকতেন। তিনি ছিলেন নজরুল ভাই-এর আত্মীয়। সেই বাসা থেকে পরচুলা ও মেয়েদের কাপড় পরিধান করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। মনসুর ভাই এ কথা নিয়ে এমনভাবে ঠাট্টা করলেন যে বিমানে কেউ না হেসে থাকতে পারলেন না। আমাদের আগরতলা পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।

 ইতিমধ্যে আগরতলায় অনেক নেতা এসে পৌঁছেছেন। কর্নেল ওসামানীর সাথে দেখা হলো। তার চেহারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত গোঁফ তিনি কেটে ফেলেছেন। প্রথমে চিনতেই পারছিলাম না। আমার নিজেরও দাড়ি কেটে ফেলেছি। দু’জনেই দু“জনকে ডেকে হাসি ঠাট্টা করলাম।

 আগের রাতে খন্দকার মোশতাক এসেছেন। ডঃ টি হোসেন ঢাকা থেকে তাকে নিয়ে এসেছেন। এম আর সিদ্দিকী কয়েক দিন পূর্বে আগরতলা এসেছেন। চট্টগ্রাম থেকে জহুর আহমদ চৌধুরী এবং সিলেট থেকে আবদুস সামাদও এসে গেছেন। তাছাড়া তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলী চাষী ছিলেন।

 ওসমানী যুদ্ধের পরিকল্পনা এবং অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা তৈরী করে ফেলেন। আধুনিক সমরজ্জায় সজ্জিত পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে আমাদের পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। ওসমানীকে সশস্ত্র বাহিনী প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হলো। তিনি এর পূর্বশর্ত হিসেবে যুদ্ধের সাজসরঞ্জামের কথা উল্লেখ করেন।

 রাতে খাবারের পর নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসেন। খন্দকার খুবই মনক্ষুণ্ণ। নাটকীয়ভাবে তিনি বললেন, আমরা যেন তাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেই। আর মৃত্যুকালে তার লাশ যেন বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি ডঃ টি হোসেনের মাধ্যমে মোশতাক সাহেবের মনোভাব জানতে চাইলাম। মোশতাক ও টি হোসেন-এর মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে। দু’জনেই এক জেলার লোক। পারিবারিক পর্যায়েও তাদের সম্পর্ক খুবই মধুর। তিনিই তাকে নিয়ে এসেছেন। আগরতলায়।

 টি হোসেনের সাথে আলাপ করে জানলাম, মোশতাক সাহেব প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী। সিনিয়র হিসেবে এই পদ তারই প্রাপ্য বলে তিনি জানিয়েছেন। সারা রাত শলাপরামর্শ হলো।

 অনিদ্রা ও দীর্ঘ আলোচনায় আমি খুবই ক্লান্তি অনুভব করি। এক পর্যায়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। শেষ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক মন্ত্রী সভায় থাকতে রাজী হলেন, তবে একটা শর্ত হলো, তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিতে হবে। তাজউদ্দিন ভাই আমাকে একথা জানান। সবাই এতে রাজি হলেন। কেননা, একটা