পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৭৯

সমঝোতার জন্য এই ব্যবস্থা একেবারে খারাপ নয়। অবশেষে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানের বিষয়টির সুরাহা হলো। একজন হেসে খবর দিলেন, তিনি যোগদানে রাজি হয়েছেন। উপস্থিত সকলে এক বাক্যে আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন। সকলে জহুর ভাইকে মোনাজাত করতে অনুরোধ করলেন। তিনি কয়েকদিন পূর্বে পবিত্র হজব্রত পালন করে এসেছেন। তার মাথায় তখনো মক্কা শরীফের টুপি। তিনি আধ ঘণ্টা ধরে আবেগপ্রবণভাবে মোনাজাত পরিচালনা করেন। তার মোনাজাতে বঙ্গবন্ধুর কথা, পাক দস্যুদের অত্যাচার, স্বজন হারানো, দেশবাসীসহ শরণার্থীদের কথা এলো। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অনেকের চোখে পানি এসে গেল। এই মোনাজাতের মাধ্যমে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিলাম।

 স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আগরতলায় অনুষ্ঠিত বৈঠককে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠক বলা যেতে পারে। তাজউদ্দিন ভাই ও আমার প্রচেষ্টায় যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল বৈঠকে সবগুলোকে অনুমোদন দেয়া হয়।

 এদিকে ওসমানী ও নগেন্দ্র সিং-এর বৈঠকে যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রস্তুতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়। বৈঠকের একপর্যায়ে আমি অংশ নেই। এর পূর্বে যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে দিল্লী কলকাতাসহ দেশের বাইরে ভেতরে সীমাবদ্ধ আলোচনা হয়েছে। সব কটিতে আমি গভীরভাবে জড়িত ছিলাম। যুদ্ধের ব্যাপ্তি, প্রকৃতি, সামরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝবার চেষ্টা করি।

 ১৩ই এপ্রিল ছোট বিমানে কলকাতা ফিরে গেলাম। মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়াও আব্দুস সামাদ আজাদ ও কর্নেল ওসমানী কলকাতা আসেন। অন্যান্যরা কলকাতায় রয়ে গেলেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পৌঁছার ব্যাপারে আমরা ২টি প্রবেশ পথ ঠিক করি। এর একটি হচ্ছে আগরতলা। এই পথে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেটের লোকজন প্রবেশ করবে। অন্যান্য জেলার লোকজনের জন্য প্রবশ পথ করা হয় কলকাতা। পরে অবশ্য সিলেটের জন্য ডাউকি, ময়মনসিংহের জন্য তোরা পাহাড়, রংপুরের জন্য ভরুঙ্গামারী, দিনাজপুরের জন্য শিলিগুড়ি, বরিশালের জন্য টাকি-এ রকম বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রবেশ পথ ঠিক করা হয়।

 মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ই এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা চিন্তা করি। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। পাক দস্যুরা সেখানে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গা রাজধানী করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত তা আর গোপন থাকেনি। চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে আমাদের নতুন স্থানের কথা চিন্তা করতে হলো।

 এই নিয়ে গোলক মজুমদারের সাথে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে সবাই একমত হন যে যেখানেই আমরা অনুষ্ঠান করি না কেন, পাক বাহিনীর বিমান হামলার বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

 শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলাকে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারন করা হয়। মন্ত্রিসভার শপথের জন্য নির্বাচিত স্থানের নাম আমি, তাজউদ্দিন ভাই, গোলক মজুমদার এবং বিএসএফ-এর চট্টপাধ্যায় জানতাম। ইতিমধ্যে দ্রুত কতগুলো কাজ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল।

 অনুষ্ঠানের কর্মসূচী নির্ধারন ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার খসড়া রচনা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বিশ্বের কাছে নবজাত বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আবেদনও বাংলা ভাষায় করা হয়েছিল। ইংরেজী কপি বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে দেয়া হয়। সবচেয়ে বড় কাজ হলো স্বাধীনতার ঘোষণারপত্র রচনা করা।

 আমি আর তাজউদ্দিন ভাই যে ঘরে থাকতাম, সে ঘরের একটি ছোট্ট স্থানে টেবিল ল্যাম্পের আলোতে লেখার কাজ করি। আমার কাছে কোন বই নেই, নেই অন্য দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কোন কপি।