পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৮৪

 ১৯শে এপ্রিল থেকেই বাংলাদেশ মিশনের একটি ভবনে তিন তলায় আমি অফিস করছি। আমার প্রথম কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে আবেদন তৈরী করা। কয়েকজন টাইপিষ্ট আমার সাতে রাত দিন কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর ১০ই এপ্রিল ও ১৭ই এপ্রিলের বক্তৃতা বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করতে হবে। স্বীকৃতির আবেদনপত্রসহ বক্তৃতার বহু কপি তৈরী করা হলো। স্বীকৃতির আবেদনে দস্তখত নিয়ে একটু ঘাপলার সৃষ্টি হল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক এগুলোতে নানা অজুহাতে সই দিতে দেরী করলেন। এদিকে আমি অস্থির হয়ে গেছি। কয়েকদিন গড়িমসি করে পরে তিনি সই করেন।

 স্বীকৃতির এই আবেদনপত্রগুলো কিছু ডাকযোগে আবার কিছু লোক মারফত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করা হয়। আবদুস সামাদ আজাদ কিছু চিঠি সহ বিদেশের পথে রওয়ানা হয়ে গেলেন। আমাদের এই স্বীকৃতির আবেদনের খবর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

 মোশতাক সাহেবের পরিবার আনার জন্যে ডঃ টি হোসেন আগরতলা থেকে আবার ঢাকা ফিরে গেছেন। আমার পরিবারের খবর সম্ভব হলে নেয়ার জন্য ডঃ হোসেনকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু তিনি ঢাকায় সন্ধান করেও আমার পরিবারের কোন খোঁজ পাননি। তার আগেই আমার পরিবারকে ঢাকা ছাড়তে হয়েছে। ডঃ হোসেন আমার প্রতিবেশী ডাঃ নাইমুর রহমানের বাসায় আমার পরিবারের খোঁজ করেছিলেন। তারা ভাল আছেন বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু কোথায় তারা ছিলেন এই খবর পাই আরো পরে। কিছুদিন পর ডঃ টি হোসেন কলকাতা ফিরে আসেন।

 ইতিমধ্যে সন্ত্রিসভা কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আমি সন্ধ্যায় মিশন থেকে বাসায় ফিরে জানলাম, আমাকে প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রিন্সিপাল এইড’ করা হয়েছে। আমার সহকারী হুইপ আবদুল মান্নানকে প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হয়॥

 আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলাম, আমাকে কেন এই পদে নিয়োগ করা হল। তিনি বলেন, এটা মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত এবং আমারও ইচ্ছা। পুনরায় জিজ্ঞাসা করি, আমার করণীয় কি হবে? তাজউদ্দিন ভাই জানান, ‘‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি যা কিছু করবো তার সবকিছুই আপনার কাজের অংশ হবে।’’

 এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে কিছু বেসামরিক অফিসার এসে গেছেন। পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের, রাজশাহীর জেলা প্রশাসক হান্নানসহ আরো অনেকে। এঁদের কাজ দেয়া হলো। রাজশাহীর জেলা প্রশাসক কয়েকদিন কাজ করে ফিরে চলে যান।

 সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে শত শত লোক প্রতিদিন আসছে। এদের মধ্যে সরকারী কর্মচারী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, উকিল, ছাত্র-যুবক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী বিভিন্ন স্তরের লোক রয়েছে। সকলেই চলে আসে বাংলাদেশ মিশনে। এদের পেশা উল্লেখ করে নাম ঠিকানা রেকর্ড হতে লাগলো। পেশা জানার উদ্দেশ্য হল প্রয়োজনে কাজে লাগানো। মিলিটারী, পুলিশ, বিডিয়ার, মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হলে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়ার কথা ছিল। এখান থেকে আমি তাদের প্রয়োজনীয় কাজে লাগাবার চেষ্টা করতাম।

 এ সময়টা আমাদের জন্য চরম সংকটের সময় ছিল। পাক হানাদার বাহিনী প্রচণ্ড হামলা করে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্তের দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রায় সকল ফ্রণ্ট থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করছে। এ সময়ে তাদের মনোবল ঠিক রেখে যুদ্ধ পরিচালনা ছিল খুব কঠিন কাজ।

 বনগাঁ সীমান্তে একটা তাঁবুতে মেজর ওসমান, তওফিক এলাহী ও মাহবুব তাদের দল বল নিয়ে অবস্থান করছেন। তখনো তারা ভারতের ভেতরে প্রবেশ করেননি। কাষ্টম চেক পোষ্টের ওপারে তাদের ছাউনী।

 সারাদিন অফিসে খুবই ব্যস্ত থাকতাম। কিন্তু শত ব্যস্ততার মধ্যেও সীমান্তে যোদ্ধাদের খোঁজ খবর প্রতি সন্ধ্যায় নিতে চেষ্টা করতাম। এ সময় আমার জুনিয়র পার্টনার ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ কলকাতা পৌঁছেন।