পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৮৫

সহযোগিতা করার জন্যে তাঁকে আমার সাথেই রাখলাম। আমার অফিসের পাশে একটা ঘরে তার বসার ব্যবস্থা হলো। প্রথম দিকে তিনি বিদেশী প্রেসের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এ কাজ তিনি খুবই দক্ষতার সাথে করেন। পরে তাকে বহিঃ প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হয়।

 এরপর বাংলাদেশ সরকার ডাকঘর স্থাপন করেন। মওদুদ আহমদ পোষ্ট মাষ্টার জেনারেল হন। বিমান মল্লিকের নকশা করা স্ট্যাম্প বাজারে ছাড়া হলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মারক হিসেবে এই ষ্ট্যাম্প ছাড়া হয়।

 দৈনিক প্রচুর লোক আসতো। এসই জিজ্ঞাসা করতো থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কোথায়? সোজা জবাব দিতাম, ‘এই প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারবে না। আপনাকে ম্যানেজ করে নিতে হবে। অর্থাৎ আপনি আমাদের ম্যানেজ কমিটির সদস্য হলেন। যেখানে রাত হবে, সেখানেই ঘুমাবার চেষ্টা করবেন। কেউ খেতে বললে কোন আপত্তি করবেন না।

 কলকাতায় অনেকের বন্ধু বান্ধব রয়েছে। অনেকে আবার বাংলাদেশ থেকে গেছেন। কিছু কিছু বাংলাদেশী সেই সূত্রে আশ্রয় লাভ করেছেন। মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়ীতে থাকতেন কেউ কেউ। পরে মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়ীর পাশে একটি স্কুলে ক্যাম্প তৈরী করা হয়। এমনিভাবে কলকাতা শহরে বিভিন্নভাবে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়। আগরতলাতেও এমনি ধরনের ব্যবস্থা হয়ে যায়। আসাম ও মেঘালয়ের জীবন ছিল আরো শক্ত। শেষোক্ত দুটি রাজ্যের মানুষ তত প্রাণখোলা ছিল না।

 এ সময় বৃটেনের শ্রমিক দলীয় সংসদ সদস্য ডগলাস ম্যান কলকাতা আসেন। আমার বন্ধু ডোনাল্ডের চেষ্টায় তিনি আমাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্যে আসেন। ডোনাল্ড আমাকে ফোন করে বলেন, ডগলাস ম্যান-এর সাথে যেন বাংলাদেশ সরকারের কারো সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেই। ডগলাস ম্যান বৃটিশ হাই কমিশনারের বাড়ীতে উঠেছেন। সেখানে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করি। মিঃ ম্যান ও আমি বাংলাদেশের ভেতরে যাব। সেখানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সাথে তার দেখা হবে।

 তাজউদ্দিন ভাই ভোরে চলে গেছেন। বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম সাক্ষাতের প্রয়োজন। তাই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাষ্টম চেক পোষ্টের কাছে প্রধানমন্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখাণে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। আমি ডগলাস ম্যানকে নিয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করি। সেখানে মেজর ওসমানকে পাওয়া গেল। বৃটিশ এমপিকে নিয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গেলাম। এই বিদেশীকে দেখে মুক্তিযোদ্ধারা খুবই খুশী হলো। তারা ডগলাস ম্যান-এর কাছে মুক্তিযুদ্ধ, পাক সেনা হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ইত্যাদি বর্ণনা করেন। আমরা তাকে অনুরোধ করি তিনি যেন আমাদের দূত হয়ে সারা বিশ্বে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কথা জানিয়ে দেন। বৃটিশ এম পি প্রথমে অভিভূত হয়ে পড়েন। প্রথমে তিনি আবেগে কথা বলতে পারেননি। কিছুক্ষণ পর মিঃ ম্যান আমার হাত ধরে বলেন, আমাকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গ্রহণ করো। তিনি আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। মানবিক গুণে গুণান্বিত খাঁটি পুরুষ ডগলাস তাঁর কথা রেখেছিলেন।

 ডগলাস ম্যান-এর এই সফর এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ-এর সাথে সাক্ষাৎ-এর খবর ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সাড়া জাগে। ডগলাস ম্যান ফিরে গিয়ে খবরের কাগজ, বৃটিশ পার্লামেণ্ট, শ্রমিক দলের বৈঠকসহ বিভিন্ন কমিটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে রিপোর্ট দেন।

 ডগলাস ম্যানকে বিদায় করে দিয়ে কলকাতা ফেরার পথে তাজউদ্দিন ভাই ও আমি যশোর অঞ্চল থেকে আগত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সাথে বৈঠক করি। তারা খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছে। সেখানেও শরণার্থী সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পথে আসতে আসতে প্রধানমন্ত্রীর সাথে শরণার্থীসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি।

 বাংলাদেশ থেকে খবর আসছে যে সেখানে সর্বত্র হানাদার বাহিনীর আক্রমণের প্রচণ্ডতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। হানাদার বাহিনীর অত্যাচার যত বৃদ্ধি পাচ্ছে শরণার্থীদের সংখ্যাও সেই হারে