পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৮৭

আমাদের সকলের চিন্তায় এক অদ্ভুত মিল রয়েছে। আওয়ামী লীগ কর্মীরা যে এক পরিবারভুক্ত তা বিপদের দিনে বুঝা যায়। কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না। যা পাবে, তা সকলে মিলে ভাগ করে খাবে এমনি মনোভাব গড়ে উঠেছে। সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা ঘুরতে ঘুরতে অনেক রাত হয়ে যেতো। কোন কোন দিন রাত ১২টার দিকে কলকাতা ফিরতাম। দিনের বেলা অফিসে আর রাতের বেলা সীমান্তে এই ছিল নিত্যদিনের কাজ। প্রধানমন্ত্রীকে প্রায়ই মনক্ষুন্ন মনে হতো। নকশালীদের তখন চরম দাপট। কৃষ্ণনগর, রানাঘাট অঞ্চলে তাদের তৎপরতা চলছে। তেমনি কলকাতায়ও। ২/১ ঘণ্টা ঘুমিয়ে, উঠে পড়তাম। সকালে নাশতার টেবিলেও তাজউদ্দিন ভাই-এর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হতো। ১২/১টার মধ্যে মিশনে গিয়ে কাজ শেষ করতাম। এরপর হোসেন আলীর সাথে দুপুরের খাওয়া সেরে নিতাম। হোসেন আলীর স্ত্রী ডালভাত পাক করতেন। বিদেশ থেকে পাওয়া চিঠিপত্রের সংক্ষিপ্ত সার ও প্রেস ক্লিপস প্রধানমন্ত্রীকে দিতাম। দুপুরের খওয়া শেষ করে সীমান্তের দিকে রওয়ানা হতাম।

 ইতিমধ্যে শরণার্থী সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করলো। সীমান্তের কাছাকাছি ভারতের কয়েকটি রাজ্যের স্কুল কলেজগুলোকে বন্ধ করে দিতে হলো। বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীরা এগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। স্থানীয় উদ্যেগে শরণার্থীদের সাহায্য করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা এক ব্যাপক যে কেন্দ্রীয় উদ্যোগ ছাড়া এর সামাধান সম্ভব ছিল না। ভারত সরকার চাল, ডাল, ইত্যাদির ব্যাবস্থা করলেন কিন্তু রান্নার হাঁড়ি, পাতিল, বাসন কোসনের অভাব রয়েছে। পায়খানা প্রস্রাব করার স্থানেরও অভাব। পানির ব্যাবস্থা নিতান্তই অপ্রতুল। এই অবস্থার জন্য আশ্রয়দাতা ও আশ্রিত কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় বিভিন্ন শিবিরে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা এসব সমস্যার আশু সামাধানের চেষ্টা করছে। কোন কোন শিবিরে কলেরা, রক্ত আমাশয় ইত্যাদি রোগ দেখা দিয়েছে। শিশু মৃত্যুর হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দীর্ঘ সীমান্ত পথ পাড়ি দিয়ে শিবিরে এসে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অনাহার ও রোগের বেশী শিকার হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। এমনও ঘটনা ঘটেছে মা মৃত শিশুকে সৎকার না করে পথিমধ্যে ফেলে এসেছে। অনাহার ক্লিষ্ট মানুষের আহার, বিশ্রাম প্রয়োজন। শরণার্থী শিবিরের করুণ অবস্থা দেখে চোখের জল বাধ মানে না। কিন্তু দুরবস্থার মধ্যে থেকেও মানুষের মনোবল কমেনি। কলকাতার বন্ধুদের আমাদের এই দুরবস্থার কথা জানাই। বিভিন্ন ত্রাণ সমিতি সাহয্যের হাত প্রসারিত করে এগিয়ে আসে।

 মৈত্রেয়ী দেবী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা কমিটির আহ্বায়িকা। তিনি ছোট একটি ত্রাণ তহবিল গঠন করেছেন। রবি ঠাকুরের স্নেহধন্যা মৈত্রেয়ী দেবী বাংলার মানুষের দুঃখের দিনে এগিয়ে এলেন। তাঁকে নিয়ে আমি বিভিন্ন শিবিরে গিয়েছি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, বিশেষ করে শরণার্থী ও স্থানীয় জনগনের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

 একটি লিফলেট ছাপা হলো। লিফলেটে শরণার্থী শিবিরে থাকার নিয়ম কানুন, সতর্কতামূলক ব্যাবস্থা ইত্যাদি লিখা ছিল। এটা শরণার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। প্রথম দিকে বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার সাহায্যে শিবির গুলো পরিচালিত হয়। পরে অবশ্য এগুলোর ভরণ-পোষণের দায়িত্বভার কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করে। চবিবশ পরগনা অঞ্চলে বরিশাল ও খুলনার শরণার্থীদের শিবির তৈরী করা হয়। এমনিভাবে মুর্শিদাবাদেও ক্যাম্প হয়েছে। রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় সমাজ কল্যাণ সংস্থাগুলোর সহায়তায় শরণার্থী শিবিরগুলো পরিচালিত হতে থাকে।

 বিভিন্ন সেক্টরে সামরিক বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কাজ চলছে। আগরতলাতে খালেদ মোশারফ ও শফিউল্লাহ নিজ নিজ ছাউনীতে নিয়মিত বাহিনীর সাথে অনিয়মিত মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলছেন। নতুন নতুন যোদ্ধা তৈরী হচ্ছে। পাক বাহিনীর সাথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লড়াইয়ে নবাগতরা অংশগ্রহণ করে।

 আমাদের সাথে ভারত সরকারের কথা হয়েছিল তারা ১ লাখ গেরিলাকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেবে। এছাড়া একটি বেতার ষ্টেশন চালুর ব্যাপারেও ভারত সরকার প্রতিশ্রুতি দেন। এদিকে ভারত সরকারের বিভিন্ন এজেন্সীর