পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৮৮

লোক আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে। কখনো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কখনো সামরিক লিয়াজোঁ আমাদের কাছে আসছে। এসব বিষয়ে সমন্বয় সাধনের জন্য বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নেয়।

 মিসেস গান্ধীর সাথে দেখা করার জন্য সকল মন্ত্রী দিল্লী যান। দেখা করে তারা কলকাতা ফিরে আসেন। এ সময় ওসমানী রজনৈতিক সচেতন ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রস্তাব করেন। রাজ্জাক, তোফায়েল প্রস্তাব নিয়ে আসেন তাদের দায়িত্ব দিলে তারা ভাল ছেলে রিক্রুট করে দিতে পারে। ওসমানী তাদের প্রস্তাবে উৎসাহ প্রকাশ করেন। তিনি আমার পাশের ঘরে থাকতেন। বালিগঞ্জে তার অফিস ছিল। তার অফিস তখনো ভালোভাবে গড়ে ওঠেনি। তিনি আমাকে একটা অথোরাইজেশন লেটার লিখে দেয়ার অনুরোধ করেন। আমি তা লিখে টাইপ করে দিয়ে দিলাম। ওসমানী তাঁর পক্ষে রাজ্জাক, তোফায়েলকে রিক্রুট করার অধিকার দিয়ে দিলেন। এই চিঠির সুযোগ গ্রহণ করেই শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আ, স, ম, আবদুর রব ‘মুজিব বাহিনী’ নামে আলাদা বাহিনী গড়ে তোলেন।

 ভারতের ২টি স্থানে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। জেনারেল ওভান এই প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। আজ পর্যন্ত আমি বুঝে উঠতে পারছি না মুজিব বাহিনী নামে এই আলাদা বাহিনীর কোন প্রয়োজন ছিল কি না। তবে যদ্দুর জেনেছি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র“-এর সাথে শেখ মনির লবি ছিল। তাকে বুঝানো হয় যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সে সময় নেতৃত্ব দিতে অসমর্থ হবে। অথবা এই নেতৃত্ব কোন প্রকার আপোষ করতে পারে। তাকে আরো বুঝানো হয়, যে যুব শক্তি স্বাধীনতার উন্মেষ ঘটিয়েছে, তারাই কেবলমাত্র সঠিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। প্রয়োজনে এই নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারবে। তাছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই নবশক্তি চীন বা নকশাল পন্থীদের বিরুদ্ধে স্বাধীন ও সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করবে। পরে আরো জেনেছি, ভারত সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয় যার অর্থ হলো; “এক বাক্সে সকল ডিম না রাখা’।’

 বিএসএফ-এর রুস্তমজী মুজিব বাহিনী গঠনের তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিন্তু তার প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত গ্রাহ্য হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলো, ভারত সরকার মুজিব বাহিনী গঠন সংক্রান্ত এই সিদ্ধান্ত মুজিব নগর সরকারের কাছে গোপন রাখে। তবে মুজিব বাহিনী গঠনের বিষয়টি আমাদের কাছে আর গোপন থাকেনি। তাজউদ্দিন ভাই-সহ আমাদের অনেককে এই সিদ্ধান্ত পীড়া দেয়। জাতি যখন সম্পূর্ণভাবে একটি নেতৃত্বের পেছনে ঐক্যবদ্ধ ও আস্থাবান তখন যুব শক্তিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা বা বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের যেমন সহায়ক হয়নি, তেমনি পরে দেশ পুনর্গঠনের কাজেও অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে।

 আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর চেয়ে বড় বিপর্যয় (সেট ব্যাক) আর কিছু হতে পারে না। আমাদের এম পি, এম এন এ ও নেতাদের মনোনীত ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ওসমানীর প্রত্যাশিত ‘সোনার ছেলে’ পাওয়া গেল না। মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দ তাকে এই সুযোগ দেননি। ওসমানীর প্রাথমিক ধারণা ছিল তারা হয়তো তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। কিন্তু পরে তিনি জানেন, এই দায়িত্বের ভার নিয়ে তাঁরা অন্য দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত ছিলেন।

 স্বাধীন বাংলা বেতার প্রতিষ্ঠার জন্যে সবাই তাগিদ দিচ্ছে। এটা আমাদের পরিকল্পনার শুরুতেই প্রধান কর্মসূচী ছিল। আমার জানামতে আমাদের নিজস্ব বেতার ষ্টেশন স্থাপনের ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। এ ব্যাপারে একটা নির্দেশ আসার কথা ছিল। কিন্তু কোন কারণে এতে জটিলতা দেখা দেয়। ভারতীয় আমলাতন্ত্রের জট খুলতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়।

 ইতিমধ্যে ভারতীয় বৈদেশিক অফিসের মিঃ রয়, মিঃ নাথ, কংগ্রেসের বহু নেতা উপনেতা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। ত্রিগুণা সেনের সাথে বাংলাদেশ মিশনে পরিচয় হয়। তিনিও সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণও আমাদের সংগ্রামের প্রতি সহানুভুতি দেখান।