কিছুদিনের মধ্যে ব্যবস্থা হলো যে আমাদের কর্মসূচী রেকর্ড করে তা স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচার করতে পারবো। আমরা বালিগঞ্জের যে বাড়ীতে থাকতাম সেখানে একটা ঘরে রেকর্ড করা শুরু হয়। একটি টেপ রেকর্ডার-এর ব্যবস্থা করে তা করা হয়। কিছুদিন পর থিয়েটার রোডের একটি বাড়ীতে রেকর্ডের কাজ করা হয়। বেতার কেন্দ্রও ঐ বাড়ীতে চলে যায়। আবদুল মান্নান বেতার পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সময় বৃটেন থেকে ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ আসেন। তার সাথে আসেন “ওয়ার অন ওয়াণ্ট”-এর পক্ষ থেকে একটি ছোট্ট প্রতিনিধি দল। সাথে ছিলেন ফাদার হার্ডেলসন ও মাইকের বার্নস এমপি। তিনি আসার আগেই আমাকে খবর দেয়া হয়। প্রতিনিধিদল সরেজমিনে শরণার্থীদরে ক্যাম্প ঘুরে ঘুরে দেখেন।
আমি তাদের থাকার জন্য সুব্রত রায় চৌধুরীর বাড়ীর তিন তলায় ব্যবস্থা করি। কিন্তু তারা সেখানে উঠেননি; তাঁরা উঠেন গ্র্যাণ্ড হোটেলে। সেখানে উঠেই টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। ফাদার হার্ডেনসন ছিলেন কলকাতায় নিযুক্ত বৃটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার। এই প্রতিনিধিদলের সাথে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তারা জানতে চান কিভাবে আমাদের সাহায্য করবেন। আমি প্রস্তাব করি, “ওয়ার অন ওয়াণ্ট” নিজেরা প্রত্যেক ক্যাম্পে সাহায্য করতে পারবে না। কারণ, সমস্যা অতি ব্যাপক। তাই তাঁরা যদি বাংলাদেশী কোন সাহায্য প্রতিষ্ঠান বা বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করেন, তাহলে আমরা তা ক্যাম্পে পৌঁছাতে পারবো।
ডোনাল্ড পূর্ব থেকেই আমাদের সাহায্যের ব্যাপারে উৎসাহী। তিনি অন্যান্য ট্রাষ্টিদের সাথে আলোচনা করে যথাসাধ্য সাহয্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি আমার কাছে পরিকল্পনা ও বাজেট চান। আমি তা দিই। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাথেও এ নিয়ে আলোচনা হয়। শরণার্থী শিবিরের সাধারণ মানুষকে সাহয্য করা ছাড়াও রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী যারা কোন কাজ করতে পারছেন না, তাদের কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
আমি বাংলাদেশ ভলাণ্টিয়ার সার্ভিস নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও এর একটা বাজেট পেশ করি। প্রধানমন্ত্রী এই সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেন। তিনি এই সংগঠন করার অনুমতি দেন।
বরিশাল থেকে নূরুল ইসলাম মনজুর ও মহিউদ্দিন এম পি অস্ত্রের জন্য আসেন। সে জেলায় তখন প্রচণ্ড প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে। বরিশাল শহর ও তার আশপাশ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। তারা জানান, অস্ত্র পেলে সেখানে তারা পাক হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন। আমি বুঝলাম, বরিশালে যে শক্তি আছে, তাদের এদিকে নিয়ে এসে নতুন সাংগঠনিক রূপরেখায় গড়ে তোলা প্রয়োজন। কিন্তু তারা তাদের সংকল্পে অটল। তাদের দু’জনেরই বিশ্বাস অস্ত্র পেলে তারা বরিশাল মুক্ত করতে পারবেন। মেজর জলিল এই সেক্টরের কমাণ্ডার। বরিশালে তিনি বীরের মত যুদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত তাদের অনুরোধ রক্ষার্থে দু’ নৌকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয়।
দুর্ভাগ্যবশতঃ পাক চরেরা আগে ভাগে এই খবর পেয়ে যায়। পশ্চিম বাংলার মুসলমানরা সাধারনতঃ আমাদের আন্দোলন সহানুভূতির চোখে দেখতো না। এদের কেউ কেউ হানাদারদের মদত দিতো। নৌকা ভর্তি অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার সময় চব্বিশ পরগনার কোন এক স্থানে পাক বাহিনী এই ছোট্ট নৌকাকে এমবুশ করে। পাক বাহিনীর হামলার হাত থেকে মনজুর রক্ষা পেলেও মহিউদ্দিন ও অপর একজন শত্রুর হাতে বন্দী হন। তাদের অকথ্য নির্যাতন করা হয়। কিছুদিন পর মেজর জলিল ও নূরুল ইসলাম মনজুর দলবল নিয়ে টকিতে এসে ক্যাম্প স্থাপন করেন।
টাকি থেকে নৌপথে খুলনা সাতক্ষীরা ইত্যাদি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমরা যেতাম। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর ও সংগঠনের অবস্থা এমনিভাবে জানা সম্ভব হতো। হাজার হাজার শরণার্থী এই অঞ্চলে বসবাস করছে। এরা খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালীর শরণার্থী। এরা নৌকায় সংসার সাজিয়ে নিয়েছে। দেশ থেকে চাল, ডাল, হাঁড়ি পাতিল সব সাথে এনেছে। হাজার হাজার নৌকায় এভাবে লোকজন বসবাস করেছে। ছিন্নমূল মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে কিভাবে ঢেউ-এর সাথে লড়াই করছে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। দুঃখী মানুষের এই