পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৯০

দুঃসাহসী মনোবল দেখে আমার মন গর্বে ভরে উঠেছে। চব্বিশ পরগনার কয়েকটি অঞ্চলে প্রধানমন্ত্রীসহ আমি বহুবার গিয়েছি।

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বেশ কিছু বিদেশী সাংবাদিক অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। এঁরা বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব গাঁথা বিশ্বের জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন। এসব বরেণ্য সাংবাদিকদের মধ্যে পিটার হেজেল হার্ষ্ট, নিউইয়র্ক টাইমস-এর সিডনী সেন বার্গ, লা মঁদের একজন সাংবাদিক ও লণ্ডনের গ্রেনেডা টেলিভিশনের প্রতিনিধি শিলার নাম উল্লেখযোগ্য।

 শিলা খুব সাহসী মহিলা। তিনি বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের চিত্র সারা পৃথিবীতে প্রচার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলার মুক্তিযুদ্ধ কাল্পনিক কিছু নয়। এক সময় শীলাকে আমি খালেদ মোশারফের যুদ্ধ ক্যাম্পে পাঠাই। খালেদ পূর্বাঞ্চলে এক দুঃসাহসী প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলেছে। খালেদ আমার পুরাতন বন্ধু। আমরা দু’জনেই ঢাকা কলেজের ছাত্র। আমি তখন ছাত্র রাজনীতি করি। সামরিক বাহিনীতে যাওয়ার পরেও তার সাথে আমার দুই-একবার দেখা হয়েছে। খালেদের দুঃসাহসিক বীরত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে। খালেদ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে শফিউল্লাহ, এম, এ, জলিল, রফিকুল ইসলাম, ওসমান চৌধুরী, নূরুজ্জামান, নজমুল হুদা, তওফিক, মাহবুবসহ আরো অনেকের ভুমিকা ছিল অনন্য।

 শিলা খালেদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রায় এক সপ্তাহ বাংকারে বসে ছবি তুলেছেন। তিনি ফিরে এসে আমাকে বলেন, আমি যা দেখেছি, এতে জোর দিয়ে বলতে পারি, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। পৃথিবীর কোন শক্তি এই অদম্য স্পৃহা দমাতে পারবে না। শিলা খালেদের বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এমনিভাবে টেলিভিশন ক্রুসহ বিদেশী প্রতিনিধি নিয়ে বহুবার রণাঙ্গনে গেছি। একদিন বয়রার কাছে একটি ক্যাম্পে যাই। ক্যাপ্টেন নজমুল হুদা ঐ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন।

 একটু পনি ভেঙ্গে শিবিরে যেতে হয়। কয়েকদিন পূর্ব থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল। ক্যাম্পে পৌঁছে দেখি কোথাও কোন শুকনো জায়গা অবশিষ্ট নেই। ছেলেদের গায়ের কাপড় ভিজে গেছে। আমরা সবাই শীতে থর থর করে কাঁপছি। বিকেল ৩/৪টা বেজে গেল, তবুও তাদের খাওয়া হয়নি। ভেজা কাঠে রান্না করতে হলো। তবুও হুদা কোন অভিযোগ করলেন না। ফেরার সময় হুদা শুধু বললেন, কিছু মশারী দিতে পারলে ভাল হয়। মশার খুবই উৎপাত। পরদিন দিলিপ চক্রবর্তীর কাছে মাশারী চাইলাম। তিনি কয়েকশ মশারীর ব্যবস্থা করে দিলেন। দুই দিন পর এই মশারী সহ ক্যাম্পে যাই। সেদিন লুঙ্গি ছিল। তাই ক্যাম্পে পৌঁছতে কোন অসুবিধা হলো না। হুদার সাথে অনেক আলোচনা হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের পর দেশে পাঠানো এবং দেশে এদের পরিচালনার ব্যাপারে নেতৃত্বের অভাব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম। আমি এসব বিষয় নিয়ে পরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করি। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন জানাই।

 বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় বহু অধ্যাপক, শিক্ষক এঁসেছেন। এঁদের মধ্যে ডঃ সারওয়ার মোর্শেদ, বেগম নূরজাহান মোর্শেদ, ডঃ এ আর মল্লিক, ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ মোশাররফ হোসেন, ডঃ স্বদেশ বোসএর সাথে কথা হলো। আমার কিছু কাজ তাদের কারো কারো মধ্যে ভাগ করে দিলাম। এখন থেকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা বিবৃতি তৈরী করার দায়িত্ব ডঃ সারওয়ার মোর্শেদ ও ডঃ আনিসুজ্জামানকে দিলাম। তারা খসড়া তৈরী করতেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে এগুলোর চূড়ান্ত রূপ দিতাম। ডঃ মল্লিককে বাংলাদেশ থেকে আগত শিক্ষকদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দেয়া হলো। তাঁর প্রচেষ্টায় সেখানে শিক্ষক সমিতি গড়ে ওঠে।

 (স্কুল) শিক্ষক সমিতির সভাপতি কামরুজ্জামান এই শিক্ষক সাহয়ক সমিতির ওয়ার্কিং প্রেসিডেণ্ট হিসেবে কাজ করেন। বন্ধু মঈদুল হাসানও কলকাতা আসলেন। তাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কয়েক দফা বৈঠক হলো। তিনি দিল্লী চলে গেলেন। সেখানে নেপথ্য থেকে তিনি আমাদের লবি সৃষ্টি করেন।