পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৯১

 এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ কোন কাজেই হাত দিচ্ছেন না। মাহবুব আলম চাষী ও তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে আগরতলা থেকে কলকাতা আসার জন্য মোশতাক চাপ দিচ্ছেন। মোশতাক-এর দাবী অনুযায়ী তাদের দু’জনকে কলকাতা আনা হলো। চাষীকে মোশতাক আহমদ পররাষ্ট্র সচিব-এর পদে নিয়োগ করেন। আমি বুঝলাম, আমার মাধ্যমে বিদেশের সাথে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে যোগাযোগ হচ্ছিল তাতে মোশতাক খুশী হতে পারেননি। চাষী কাজ শুরু করেছেন। মোশতাক এরপর দাবী করলেন, বাংলাদেশ মিশনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্য কোন বিভাগ থাকতে পারবে না। এতদিন আমি বাংলাদেশ মিশনে কাজ করেছি। মোশতাকের এই নতুন দাবীর অর্থ বুঝতেও আমার অসুবিধা হলো না। অর্থাৎ আমাকে সার্কাস এভিনিউস্থ পররাষ্ট্র মিশন থেকে তাড়াতে হবে।

 থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আমার বসার ব্যবস্থা করা হলো। আমার পরিবার না আসা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও আমি একটি ঘরের দুইটি চৌকিতে থাকতাম। থিয়েটার রোডের বাড়ীটি বেশ বড়। সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবার না আসা পর্যন্ত তিনিও এখানে থাকতেন। এরপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক ও কামরুজ্জামান পৃথক পৃথক ফ্ল্যাটে ওঠেন। কিন্তু পরিবার আসার পরেও প্রধানমন্ত্রী থিয়েটার রোড ত্যাগ করেননি। তাজউদ্দিন ভাই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যতদিন দেশ স্বাধীন না হবে, ততদিন তিনি পারিবারিক জীবনযাপন করবেন না। তিনি বলতেন, যুদ্ধরত অবস্থায় যোদ্ধারা যদি পরিবার বিহীন অবস্থায় থাকতে পারে, আমি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তা’ করতে পারবো না কেন? তিনি তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন।

 আমার পরিবার আসতে অনেক দেরী হয়ে যায়। ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আমার ছোট্ট পরিবার ৩ ভাগে বিভক্ত ছিল। আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে, ছেলে প্যাবলু স্ত্রীর সাথে, আর মেয়ে শম্পা তার নানীর সাথে গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জে। ২৫শে মার্চের পর পাক বাহিনী নারায়ণগঞ্জ আমার শ্বশুরের বাড়ী এবং স্ত্রীর ভাই মুস্তাফা সারোয়ারের বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মেয়েটি তার নানীর সাথে মানুষের মিছিলে শামিল হয়। এরপর বহু কষ্টে শ্বশুরের পৈতৃক বাড়ী দাউদকান্দির জামালকান্দিতে উপস্থিত হয়।

 আমার স্ত্রী লীলা আমার কোন খোঁজ খবর পাননি। বাড়ীওয়ালী বেগম হাবিবদ্দিন ওপর তলায় থাকতেন। আমাদের সাথে তাঁর খুবই সদ্ভাব ছিল। আমি তাকে খালাম্মা ডাকতাম। তিনিও পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। কিন্তু ২৫শে মার্চের পর আমার স্ত্রীকে ৪ বছরের ছেলেসহ বাড়ী ছাড়তে বাধ্য করেন। স্ত্রী পাশের বাড়ীর নাইমুর রহমানের সাথে আমার খোঁজে মুসা সাহেবের বাড়ীতে যান। আমি মুসা সাহেবের বাড়ীর ছাদের যে ঘরে থাকতাম, সেখানের একটি চৌকিতে একটি রক্তাক্ত চাদর ছিল। আমার স্ত্রী এই চাদর দেখে ফেলেন। ২৫শে মার্চ রাতে সেই চৌকিতে একজন গাড়ী চালক ঘুমিয়েছিল। হানাদারদের গুলিতে সে নিহত হয়। এরপর লীলা আমার খোঁজে শ্বশুরবাড়ী নারায়ণগঞ্জে রওয়ানা হন। কিন্তু তিনি সেখানে যেতে পারেননি। ফতুল্লায় পাকবাহিনী ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রাখে। ফিরে এসে তিনি দু’একজন আত্মীয় স্বজনের বাসায়ও যান। কিন্তু অনেকেই সেদিন তাকে ভাল চোখে দেখেননি। তবে কোন এক সাহসী সহৃদয় আত্মীয়ের বাড়ীতে আমার স্ত্রী প্রায় দু’সপ্তাহ অবস্থান করেন। সেখান থেকে ডাঃ নাইমুর রহমানের স্ত্রীর সহযোগিতায় গাড়ীযোগে তিনি নারায়নগঞ্জে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে শ্বশুরবাড়ীর কাউকে না পেয়ে নৌকাযোগে জামালকান্দি চেল যান। তখনো আমার মেয়ে সেখানে পৌঁছেনি। নদীর প্রায় কাছাকাছি আমার শ্বশুরের গ্রামের বাড়ী। মিলিটারী হামলার আশংকায় আমার পরিবারের লোকজন ভয়ভীতির মধ্যে সেখানে অবস্থান করেছে। হানাদারদের গান বোটের হামলার আশংকায় আমার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে গ্রামান্তরে দৌড়াতে হয়েছে। তাছাড়া তিনি তখনো জানতে পারেননি আমি কোথায়, কি অবস্থায় রয়েছি। আওয়ামী লীগের একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী রহমত আলীর কাছে খবর পেলাম আমার স্ত্রী জামালকান্দিতে রয়েছেন। রহমত আলীর কাছে তাজউদ্দিন ভাই-এর পরিবারের খবর পাওয়া গেল। রহমত আলী জানান, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকে নিয়ে আসবেন। আমি রহমত আলীর কাছে চিঠি দিলাম। রহমত আলী প্রথমে বেগম তাজউদ্দিন ও জুন মাসের শেষ দিকে আমার পরিবারের লোকজনকে কলকাতায় নিয়ে আসেন।