পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৯৪

জয় আমাদের ছেড়ে চলে যায়। অর্থাভাবে জয়-এর চিকিৎসা করাও সম্ভব হয়নি। ক্লিনিকে মৃত্যুপথযাত্রী জয়কে নেয়া হয়। সেলাইন দেয়ার কথা ডাক্তার বলেন। সেলাইন-এর বিল আমরা পরিশোধ করতে পারবো কি না, এই নিয়ে ক্লিনিকের কর্তৃপক্ষ চিন্তিত ছিল। কিন্তু সেলাইন দেয়ার আর প্রয়োজন হয়নি। তার আগেই জয় চলে যায়।

 পুত্রশোকের অভিজ্ঞতা যেন কোন পিতা মাতার না হয়। আমি জয়কে নিজ হাতে মাটিতে নামিয়ে দেয়ার সময় আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি আল্লাহ আমার জয়-এর পরিবর্তে আমাদের স্বাধীনতা দিও। এই শোক সামলে নিতে আমার প্রায় সপ্তাহ খানেক সময় লাগে। কিন্তু আমার স্ত্রীর সেই স্মৃতি আজো মুছে যায়নি। তাছাড়া কোন মায়ের পক্ষে তা সম্ভবও নয়। ডঃ স্বদেশ বোস পরে বলেছিলেন, সন্তান পেটে থাকা অবস্থায় পথে পথে ঘুরে এবং খাদ্য ও বিশ্রামের অভাবে মা ও সন্তানের অপুষ্টি হয়। এই সন্তান বেচেঁ থাকলেও সংশয় মুক্ত ছিল না। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছি প্রতিদিন শরণার্থী শিবিরে বহু শিশু চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। এরপর থেকে স্ত্রীও আমার সাথে সীমান্ত শিবির দেখতে যেতেন। এমনিভাবে স্ত্রী আমার কাজের সহযোগী হয়ে ওঠেন। আমরা এ সময়ে বিভিন্ন শিবিরে অর্থকরী কাজে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কর্মসূচী গ্রহণ করি। তাছাড়া প্রতি ক্যাম্পে শিশু কিশোরদের জন্য কয়েকটি নির্ধারিত কর্মসূচী ছিল। প্রতি ক্যাম্পে ভোর বেলা পতাকা উত্তোলন, মুক্তিযুদ্ধের গান, পিটি শরীরচর্চা ও খেলাধুলা এই কর্মসূচীর অন্তর্ভূক্ত ছিল। এগুলো ক্যাম্পে ক্যাম্পে প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করে। ক্যাম্পগুলোতে ময়লা নিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ড্রেন কাটা, নালা সাফ, আবর্জনা পরিস্কার ও ব্লিচিং পাউডার ছিটানোর ব্যবস্থা করা হয়। আমাশয় রোগে বিভিন্ন শিবিরে বহু লোক মারা যায়। তন্মধ্যে শিশু মৃত্যুর হারই বেশী। ডাক্তার ও ওষুধের প্রচণ্ড অভাব। প্রত্যেক ক্যাম্পে মেডিক্যাল সেণ্টার খোলার সঙ্গতি আমাদের নেই।

 এ সময় আমি হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারদের খুঁজে বের করে প্রত্যেক ক্যাম্পে নিয়োগ করি। তাদের ওষুধের বাক্স দেয়া হল। এতে বেশ কাজ হলো। সীমান্তের নিকটে আমরা হাসপাতাল গড়ে তুলি। একজন কর্মঠ ডাক্তার এবং তাকে সাহায্যকারী কয়েকজন নার্স পেলেই হাসপাতাল শুরু করা যায়। কোন ছোট গুদাম জাতীয় স্থান নামমাত্র অর্থে ভাড়া নিয়ে সেখানে ছোট ছোট চৌকি ফেলে ১০/১২ বেডের হাসপাতাল তৈরী করা হতো। বিভিন্ন সংস্থার সাহায্য সহযোগিতায় হাসপাতাল পরিচালনা করা হয়।

 এসব হাসপাতাল আমাদের খুবই উপকারে আসে। এতদিন পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে আহত যেসব মুক্তিযোদ্ধা সামান্য চিকিৎসার অভাবে মারা যেত, হাসপাতালগুলো চালু হওয়ার পর তারা চিকিৎসা পেতে থাকে। ডাক্তারী পড়া ছাত্ররা এসব হাসপাতালে চমৎকার সাফল্য দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার এমপিদের প্রতি মাসে ২০০ টাকা মাসহারা দিত। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের এ ধরনের কোন আর্থিক সুবিধা ছিল না। বিভিএস (বাংলাদেশ ভলাণ্টিয়ার সার্ভিস)-এর পক্ষ থেকে এসব রাজনৈতিক ও সমাজকর্মীদের মাসিক ৫০ টাকা মাসহারা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। দুঃসময়ে এ টাকা তাদের খুবই কাজে আসে।

 প্রধানমন্ত্রী আমাকে দু’বার দিল্লী পাঠান। প্রথমবার দিল্লী যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার বিভিন্ন এজেন্সীর লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করা। সেখানে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সাথে আমার দেখা হয়। এদের কাছে বিভিন্ন ধরনের খবর পাওয়া গেল। বিশিষ্ট সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার-এর সাথেও আলোচনা করি। তাছাড়া দিল্লীতে অবস্থিত বিদেশী মিশনের কর্মকর্তাদের সাথেও পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হই।

 এদের সাথে সাক্ষাতের সময় শুনতাম বেশী, বলতাম কম। দেশ-বিদেশে আমাদের সংগ্রামের প্রতিক্রিয়াসহ পরাশক্তিসমূহের মনোভাবও জানার সুযোগ হয়। ভারত সরকার সম্পর্কেও অনেক খবর জানা সম্ভব হলো। হিন্দুস্তান টাইমস-এর সম্পাদক উইলিয়াম ভারগিস ও তার মত আরো অনেকে বুঝাতে চান, ভারতের সকলে যে বাংলাদেশের পক্ষে আছে বা থাকবে এ ধারণা করার কোন কারণ নেই। তারা বলেন, আজো অনেকে ভাবেন যে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানই ভারতের জন্য মঙ্গল হবে। কারণ পাকিস্তানকে এতদিনে চেনা-জানা হয়ে গেছে।