পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৯৬

এটি পাক দূতাবাসের সামনে অবস্থিত ছিল। রাষ্ট্রদূতের পরবর্তী কর্মকর্তা আমাদের সাথে দেখা করেন। অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে তিনি আমাদের বক্তব্য শোনেন। তিনি বলেন, দূতাবাসের পক্ষ থেকে আমাদের বক্তব্য তিনি মস্কোতে পাঠাবেন। এর বেশী কিছু তিনি করতে পারবেন না বলে জানান। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ আমাদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে আগ্রহী ছিলেন না। আবদুস সামাদ আজাদ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শান্তি সম্মেলনে মস্কো যান। তখনো তিনি সেভিয়েতের কোন নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তির সাক্ষাৎ লাভে সমর্থ হননি।

 শান্তি সম্মেলনের সময় খাবার টেবিলে বিভিন্ন প্রতিনিধিদের পতাকা থাকতো। আবদুস সামাদ আজাদ সেখানে বাংলাদেশের পতাকা রাখার দাবী জানালে স্বাগতিক দেশ অসম্মতি প্রকাশ করে। এমনকি বাংলাদেশ প্রতিনিধি ব্যক্তিগতভাবে একটি পতাকা রাখতে চাইলে মস্কোর তা পছন্দ হয়নি। এরপর আব্দুস সামাদ আজাদ নিজের ঘরে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

 তাজউদ্দিন ভাই সাংবাদিক মঈদুল হাসানের মাধ্যমে মস্কোর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। আমাদের সংগ্রামের প্রতি সরাসরি সমর্থন করতে মস্কোর যে অসুবিধা ছিল, সেটা আমরা বুঝতাম। তবে আমাদের সংগ্রামের প্রতি যে মস্কোর সমর্থন রয়েছে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের পর পাক সরকারের কাছে প্রেরিত প্রেসিডেণ্ট পদগোর্ণি প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। বিশ্ব রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্যই সে সময়ে মস্কোর পক্ষে আমাদের সংগ্রামের প্রতি সরাসরি সমর্থন দেয়া সম্ভব হয়নি।

 তবে একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে সোভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দেয়ার জন্যে ভারতের সাথে খোলাখুলি আলোচনা শুরু করে। আমাদের সংগ্রাম চলার সময় মিঃ হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে চীন সফর করেন। আর চীন-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির ব্যাপারে পাকিস্তান দূতিয়ালী করে। এই ঘটনা ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের প্রেক্ষিত রচনা করে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অবস্থা ও বৃহৎ শক্তির ভারসাম্যের আলোকে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবস্থান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ভবিষ্যদ্বাণী কার্যে পরিণত হয়েছিল।

 এসব আলোচনাকালে আমরা দু’জনেই মোটামুটি একইরকম মতামত পেশ করতাম। কিসিঞ্জার চীন সফরের খবরের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সফর আমাদের সংগ্রামে প্রভাব বিস্তার করবে। পরে এটা সত্যে প্রমাণিত হয়। মস্কো উপলদ্ধি করে যে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তান এই অঞ্চলে রাশিয়াবিরোধী জোট গঠনে ব্যস্ত রয়েছে। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করতে চীন-মার্কিন তখন বিশেষভাবে ব্যস্ত।

 চীন-মার্কিন সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর রুশ-ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবেই ঘনিষ্ঠতর হয়। এখন রাশিয়ার পক্ষ থেকে ভারতের একটি আশ্বাস প্রয়োজন। সেই আশ্বাসটি হলো, কোন কারণে চীন ভারতে হামলা করলে রাশিয়া যেন পাল্টা চাপ সৃষ্টির ব্যবস্থা করে, যাতে চীন নির্বিঘ্নে ভারতে ঢুকে পড়তে না পারে।

 হিমালয়ের তুষার ও সোভিয়েতের বন্ধুত্ব এই দু’টি ছিল চীনের বিরুদ্ধে ভারতের রক্ষা কবচ। তাই সময় ও সুযোগে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে ভারত যখন অপেক্ষা করছিল, সে সময় বাংলাদেশের বীর সন্তানেরা গভীর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে পাক বাহিনীর মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

 দিল্লীতে আমি ভারতের বৈদেশিক দফতরে টি এন কাউলের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদেরকে বিদেশে প্রচার কাজের ওপর জোর দেয়ার কথা বলেন। তিনি বিদেশের বিভিন্ন রাজধানী, সেখানকার সরকার, সংবাদপত্র ও জনমত সম্পর্কে আমাদের একটি ধারণা দেন। আমি এসব দিল্লী সফরের রিপোর্ট হিসেবে একটা নকশার মত প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করি।