পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৯৭

 আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিশ্বের সরকারগুলো কে কি ভাবছে, তা বুঝতে আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি। এ ব্যাপারে তাজউদ্দিন ভাই-এর একটি মোটামুটি হিসেব ছিল। তিনি জোর দিয়েই বলতেন যে আগামী শীতেই একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। কেননা এছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।

 মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্যে প্রতিদিন সীমান্ত পার হয়ে শত শত তরুণ যুবক আসছে। তাদের মুখে এক কথা—ট্রেনিং চাই, অস্ত্র চাই। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণে ইচ্ছুক যুবক ছাড়াও প্রতিদিন বহু লোক আমার অফিসে সাক্ষাৎ করতে আসতেন তাদের প্রত্যেকের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে।

 বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ভিড় করা শুরু করলেন। তাদের সবার বক্তব্য, স্ব স্ব স্থানের ছেলেদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা বুঝতে পারলাম, যে সংখ্যায় মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা আমরা করেছি, এর চেয়ে বহু বেশী সংখ্যায় যুবকরা আসছে প্রশিক্ষণের জন্যে। এ সময় আমরা ‘ইয়ুথ ক্যাম্প’ খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এই ক্যাম্প গুলো এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা পরিচালনা করেন।

 এর পরের ধাপ ছিল অভ্যর্থনা শিবির। অভ্যর্থনা শিবিরের কাজ ভারতীয়রা ও আমরা যৌথভাবে পরিচালনা করতাম। মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যর্থনা ক্যাম্প থেকে ছয় সপ্তাহের ট্রেনিং-এ পাঠানো হতো।

 প্রথমে আমাদের ২৫ হাজার গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল। পরে এই সংখ্যাকে এক লক্ষ্য উন্নীত করা হয়। এর মধ্যে ট্রেনিং শেষ করে ৯০ হাজার স্বদেশে আসতে সক্ষম হয়। তাছাড়াও ছিল নিয়মিত বাহিনী। সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী ও বিডিআর-এর সৈনিকদের দ্বারা এই বাহিনী গঠন করা হয়। পুলিশের সংখ্যাও ছিল পর্যাপ্ত।

 সীমান্তে ছাউনি তৈরী করে নিয়মিত বাহিনী অবস্থান করতো। সেখান থেকেই তারা পাক বাহিনীর ওপর হামলা করেছে। তাছাড়া ছিল সহায়তাকারী একটা গোষ্ঠী। একটু বয়স্ক, যাদের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সম্ভব ছিল না, তারা ‘ইয়ুথ ক্যাম্প’ ও ‘অভ্যর্থনা ক্যাম্পে’ নিয়মিত বাহিনীর সাথে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতো।

 ইয়ুথ ক্যাম্প করতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পাওয়া গেল। বাংলার হাজার হাজার দামাল ছেলের দ্বারা ক্যাম্পগুলো ছিল পরিপূর্ণ। তাদের শুধু একটাই কথা ট্রেনিং চাই, অস্ত্র চাই। খান সেনাদের যে কোন মূল্যে খতম করতে হবে।

 এ সময় আমি নিয়মিত ইয়ুথ ক্যাম্পে যেতাম। প্রিনসেপ স্ত্রীটে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি অফিস খোলা হল। এই মন্ত্রণালয় ইয়ুথ ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। কাজের মাধ্যমে ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামানের সাথে আমার সম্পর্ক আরো গভীর হয়ে ওঠে। সপ্তাহে কয়েকবার আমাদের বৈঠক হতো। এতে কাজের সমন্বয় বৃদ্ধি পায়। কামরুজ্জামান (হেনা ভাই) ও আমি সড়ক পথে বাংলাদেশের পুরো সীমান্ত দেখার জন্য ২৫ দিনের এক কর্মসূচী গ্রহণ করি। স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুল খালেক আমাদের সাথে ছিলেন। ২৫ শে মার্চ রাতে খালেক রাজশাহীতে ছিলেন, পরে সীমান্ত পার হয়ে আসেন। আবদুল খালেক পুলিশ বাহিনীর লোকদের সংঘবদ্ধ করেছেন। তিনি অত্যন্ত অমায়িক লোক। তাঁর উদ্যম ও কর্মোৎসাহ আমাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি ছিলেন একটি ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রের অধিকারী। আমরা রওয়ানা হই কলকাতা থেকে। মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম দিনাজপুরের শিলিগুড়ি পার হয়ে মেঘালয়ের তোরা পাহাড় অঞ্চলের পাদদেশে আমরা ক্যাম্প স্থাপন করি। ফিরে আসার সময় পথে পথে সকল ক্যাম্প পরিদর্শন করি।

 আমাদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা হতো ইয়ুথ ক্যাম্পে। ইয়ুথ ক্যাম্প ছাড়াও পথিমধ্যে নিয়মিত যোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে গেছি। আমাদের এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের সরেজমিনে দেখা এবং স্থানীয় ও ভারতীয় প্রশাসন যন্ত্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। তোরাতে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা হলো।