পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১০১

শিকারপুর, মুজিবনগর, বেনাপোল, মামা ভাগ্নে, টাকি, দেবহাটা এগুলো ছিল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাইল পোষ্ট। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের মানচিত্র কে মালা দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে।

 সীমান্তের ওপারে এক কোটি মানুষের ভিড়। এরা ঘরে ফিরতে আগ্রহী। শৃংখল মুক্তির উদ্দাম আবেগ তাদের মনে। মুক্তিযোদ্ধারা প্লাবনের মত সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। এরা বাংলার নিভৃত গ্রামে, অরণ্যে মাঠে, নদী খাল বিল, হাটে ঘাটে, বাজার ও শহরের পাড়াতে ছড়িয়ে রয়েছে।

 দেশের জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ভরসা করে রয়েছে। এরা ঢাকার ইণ্টারকন থেকে মতিঝিল আবাসিক এলাকা, ফার্মগেট, মফস্বল শহরের রাজপথ, গঞ্জে বাজারে, ধানক্ষেতে রাজাকারের ক্যাম্পে, দালালের গৃহে, হানাদার বাহিনীর ছাউনিতে ত্রাস সৃষ্টি করেছে। আগরতলায় এসে আমরা মেজর শফিউল্লার সাথে মিলিত হলাম। শফিউল্লাহ হরিণাতে ক্যাম্প স্থাপন করে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করে আসছেন।

 আমরা মেজর খালেদ মোশারফের ক্যাম্পেও গেলাম। ক্যাপ্টেন রফিক খুব শীর্ণ হয়ে পড়েছেন। তার মুখে খোঁচ খোঁচা দাড়ি। অনেক দিন পরে তার সাথে দেখা। ইয়াহিয়ার শাসনামলে তিনি কুষ্টিয়া ছিলেন। দু’সপ্তাহ পূর্বে তিনি ফ্রণ্ট থেকে ফিরেছেন। কয়েকদিন পূর্বে তার জ্বর হয়েছিল। জ্বর থেকে সেরে উঠেছেন। যুদ্ধে ফিরে যাওয়ার জন্যে তিনি উদগ্রীব। এই ক্যাম্পে সবার সাথে মাটিতে বসে আমরা দুপুরের খাবার খেলাম।

 সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদের উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দিত। পাক সেনাবাহিনী তখন আগরতলা সীমান্তে দারুন চাপ সৃষ্টি করছে। তাদের গোলা সীমান্ত পার হয়ে শরণার্থী শিবির পর্যন্ত আসছে। হানাদারদের হটাবার জন্যে আমাদের মুক্তিবাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে।

 এ সময় চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম, এ হান্নানের সাথে দেখা হলো। আমরা বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করি। আগরতলাতে জনসংখ্যার চেয়ে শরণার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। ফেরার পথে মালেক উকিলের সাথে দেখা হলো। এখানে ছোট পরিবার নিয়ে তিনি থাকেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী যেখানে যান সেখানেই বিপুল লোকের সমাগম হয়। তাদের দু’জনের আগমনে এখানে প্রাণচাঞ্চল্য বয়ে গেল।

 পরদিন সকালে আমরা খালেদ মোশারফের ক্যাম্পে গেলাম। খালেদ আমাদের জানান, এই মুহূর্তে তিনি আমাদের কুমিল্লা অঞ্চলে নিয়ে যেতে পারছেন না। কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়ক তিনি অবরোধ করে রেখেছেন বলে আমাদের জানান। তার লোকজন অনেক গভীরে যোগাযোগ স্থাপন করে রেখেছে। আমাদের নিয়ে তিনি জঙ্গলের পথে বের হলেন। পাহাড়ের গা ঘেঁষে কয়েকটি পরিচ্ছন্ন গ্রাম। ভারতীয় সীমান্তের সাথে লাগানো। এই গ্রামের মানুষের সাথে আমাদের মুক্তিবাহিনীর একটা সখ্যতা স্থাপিত হয়ে গেছে। পুকুর থেকে গ্রামের মেয়েরা পানি নিচ্ছে, তারই পাশ দিয়ে চলাচল করছে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা। গ্রাম থেকে একটু দূরে আম বাগানের ভিতরে বৃহৎ কামান বসিয়ে গোলা ছুড়ছে আমাদের গোলান্দাজ বাহিনী। এই কামানগুলো খুব পুরানো বলে মনে হলো। এগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী। খালেদ আমাকে কামানের সামনে নিয়ে গেল। আমার মাথার ওপর দিয়ে কামানের গোলা উড়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক উত্তেজনায় শিহরণ। এরপর খালেদ পাহাড়ে ওঠার জন্যে আমাদের আমন্ত্রন জানান। তিনি আমাদের কে শত্রুর শিবির দেখানোর কথা বলেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে না নিয়ে যেতে পারলেও সড়কটি আমাদের দেখাতে চাইলেন। কণ্টকাকীর্ণ পথ। খালেদের চাল-চলন দেখে মনে হলো, তিনি যেন এখানে মানুষ হয়েছেন। তার কাঁধে একটি দূরবীণ, পায়ে বুট এবং হাতে একটি ছোট্ট ছড়ি। আমাদের হাতেও এমনি করে লাঠি দিয়েছেন পথ চলার সুবিধার জন্যে। আমার উঠতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। নজরুল ভাই কে নিয়ে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। পাহাড়ে উঠে দূরবীণ দিয়ে খালেদ কি যেন দেখলেন। এক সময় খালেদ পাক-ছাউনি দেখালেন। আমি দেখলাম। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কও দেখলাম। রাস্তাটি একেবারে জনমানবহীন।

 আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী তখনও গোলাবর্ষণ করছে। শত্রু বাহিনীর ছাউনীর কাছে সেই গোলা গিয়ে পড়ছে। শত্রুছাউনীর পাশে একটি রেস্ট হাউজ দেখা যাচ্ছে। খালেদ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন।