পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১০২

কতক্ষণ পরে ক্যাম্পে ফিরে গেলাম। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জোয়ানদের সাথে খেলেন। ইতিমধ্যে গাফফার (অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল) একটি ছোট বাহিনী নিয়ে আসেন। গাফফার অত্যন্ত সাহসী যোদ্ধা। বাড়ী খুলনা। অসম সাহসী, ধীর, স্থির। একটা ভাল লাগার মত ব্যক্তিত্ব। তার কাছে যুদ্ধের বহু কাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথা শুনলাম। সন্ধ্যা হতেই আমরা আগরতলা ফিরে আসি। পরদিন আমাদের কলকাতা যাবার কথা। বি.এস.এফ-এর মালবাহী বিমানে আমাদের যাবার ব্যবস্থা হয়েছে। খালেদ সকাল বেলা আমাদের বিদায় জানাতে এলেন। তিনি তার সুবিধা-অসুবিধা এবং আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতৃস্থানীয় লোকের সাথে যোগাযোগের অভাবের কথা জানান। কিছু দিন পূর্বে মুজিব বাহিনীর কার্যক্রমের সাথে যে ভুল বুঝাবুঝিার সৃষ্টি হয়, আমরা তা’ দূর করতে সক্ষম হই। দুইদিন পর কলকাতায় এসে আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির বৈঠকে আমরা সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করি। এই সময় খবর আসে যে খালেদ মোশাররফ আহত হয়েছেন। তাকে লক্ষ্‌ণৌ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি।

 আওয়ামী লীগের এই বৈঠক ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তখন বুঝতে পারি যে উপমহাদেশের পরিস্থিতি ও যুদ্ধের সামগ্রিক পরিস্থিতি সব কিছু মিলে আমাদের সংগ্রাম চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে গেছে। এ সময় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব আসে। বাংলাদেশের শরণার্থীদের নিয়ে আমরা দেশের ভেতরে যেতে পারি কিনা। ভূ-খণ্ড দখলের ব্যাপারে ভারত সরকার সাহায্যের আশ্বাস দেয়। আমরা এ প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করি। আমরা জানি, বাংলাদেশের প্রায় সকল মানুষই আমাদের সংগ্রামের পক্ষে। হানাদার বাহিনীর বন্দুক কামানের বাইরে সারা দেশেই বলতে গেলে স্বাধীন। আমাদের তাই নতুন করে ভূ-খণ্ড দখলের প্রয়োজন নাই।

 ইতিমধ্যে আমরা আমাদের কথার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে সক্ষম হই। জুলাই মাসের পর মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। শত্রুদের মধ্যে সৃষ্টি হয় ভয়ভীতি। বিশ্বব্যাংকের একটি দল আগষ্ট মাসে ঢাকা আসে। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে পাক সরকার সাহায্য পাবে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা তখন ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে ১২ই আগষ্ট তারিখে। বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে বলে পাক সরকার যে প্রচার চালাচ্ছিল এই গ্রেনেড নিক্ষেপের ফলে তা অনেকটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

 মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গেরিলা যোদ্বারা অতি অল্প সময়ে শত্রু হননের কলা কৌশল রপ্ত করে। প্রথমদিকে পাক বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশল পরিবর্তন করে গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

 জুন মাসের একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি। কুষ্টিয়া কলেজের ছাত্র বীর যোদ্ধা তারেক। এক সম্মুখ সমরে তারেক শহীদ হয়। কৃষ্ণনগর ক্যাম্প পরিদর্শনে গেছি। শুনলাম, তারেক দলবল নিয়ে যুদ্ধে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে আসলো, কিন্তু তারেক ফিরে আসলো না। জরুরী কাজে আমার কলকাতা ফিরে আসা দরকার। ক্যাম্পের বাইরে ৪টি ছেলেকে দেখতে পাই। তাদের মুখে শুনলাম কিভাবে তারেক বীরের মত শহীদ হয়েছে। আমি তাদের বল্লাম, “যুদ্ধে বিজয় বড় কথা নয়, সবচেয়ে বড় কথা হলো বীরত্বের কথা। আমরা তারেকের গর্বে বেঁচে থাকবো। তারেক শহীদ হলেও তার একটা জিনিস পাওনা আছে। তা হলো তার বন্ধুদের কাছ থেকে সম্মান। তাঁকে সেই সম্মান দেখাতে হবে। তোমরা তার লাশ আনতে পারোনি। তার আত্মাকে তোমরা নিয়ে এসেছো। এসো, আমরা তাকে সম্মান করি।“

 সকলকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হলো। পতাকা অর্ধনমিত রাখা হলো। আমরা শ্রদ্ধার সাথে তারেককে সম্মান করলাম। সবার চোখে নেমে এলো অশ্রুধারা। ধরা গলায় আবার গাইলাম ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’

 অন্য একদিনের ঘটনা। শিকারপুর ক্যাম্প। তওফিক এলাহী এই ক্যাম্পের অধিনায়ক। যুদ্ধে একজন আনসার মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাশ নিয়ে আসে। বুট পায়ে সামরিক