পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১১১

বিজ্ঞান ভবনের পূর্বপার্শ্বে পটিয়া থানার সংগ্রাম পরিষদ নেতা অধ্যাপক ফজলুল করিম ও আরো কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে দেখা হয়। ঐ দিন কালুরঘাট হতে পটিয়া পর্যন্ত যে সমস্ত বাংলা বাহিনী ছিল সবাই যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। আমি আশেপাশের যুবকদের একত্রিত করে আলাপ আলোচনা করি। এর পরের দিন একটা গ্রেনেড নিয়ে শহরে গমন করি এবং বিকেল তিনটায় বাসায় গিয়ে উপস্থিত হই। হানাদার বাহিনীর কয়েকটা ট্রাক সে সময় চকবাজারের দিকে যাচ্ছিল। রাত সাতটার দিকে স্টীম লণ্ড্রীর ছাদ থেকে আমি একটা ট্রাক লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারি। ট্রাকটি কয়েকজন হানাদার ও অস্ত্রশস্ত্রসহ সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়। আমি ঐ ছাদেই শোয়া অবস্থায় ছিলাম। অন্যান্য ট্রাক হতে পাক সৈন্য রাত একটা পর্যন্ত গুলি চালায়। আশেপাশে সব দোকান পুড়িয়ে দেয়। তারা সরে পড়লে আমি অতি গোপনে হাঁটতে হাঁটতে সকালে পাথরঘাটা পৌঁছি। দুইদিন দুইরাত হেঁটে মিরেরশরাই পৌঁছি। তারপর অতি কষ্টে ২১ শে এপ্রিল শ্রীনগর সীমান্ত পার হই। সেখানে মিরেরশরাই - এর পি মোশারফ হোসেনের সাথে সাক্ষাৎ করি। এর পরের দিন ছাগলনাইয়ার প্রাক্তন এম এন এ ও সাবেক পটিয়া কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। পরের দিন বাসে করে বেলুনিয়া যাই। সেখানে পাক বাহিনী ও আমাদের বাহিনীর সঙ্গে যে সংঘর্ষ চলছিল তাতে আমি অংশ নেই। দু’জন আহত ই পি আরকে নিয়ে বেলুনিয়া হাসপাতালে চিকিৎসার পর ক্যাম্পে পৌঁছিয়ে সাবরুমে যাই। সেখানে এম, এ, হান্নান, এস, এম, ইউছুফ, মির্জা মনসুর, স্বপন কুমার চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র লীগের সভাপতি হাসেম, চট্টগ্রাম কলেজের ভিপি জামাল উদ্দিন এবং সাবের আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে বাংলাদেশ হতে যুবকদেরকে এনে গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমরা উপস্থিত কয়েকজন লোক এবং কয়েকজন ই, পি, আর নিয়ে একটা ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করি। এই ক্যাম্প পরিচালনার জন্যে হাসেম, মণ্টু, মহিউদ্দিন ও আমি রইলাম। বাকী কয়েকজন আলাপ আলোচনার জন্যে আগরতলায় চলে গেলেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও কিছু সংখ্যক লোক এসে আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেন। এ সময় আগরতলা থেকে এস, ডি, ও ও আরো কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তা আগমন করলে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে রেশনের ব্যবস্থা করি।

 কিছুদিন এভাবে ক্যাম্প চললো। কিন্তু ভারতে আগমনকারী বাঙ্গালীদের মধ্যে সবাই শরণার্থী হিসেবে আসতো। ট্রেনিং নেয়ার লোকের অভাব উপলদ্ধি করে আমি চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের তালিকা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। প্রায় ১ মাস ১৭ দিন পায়ে হেটেঁ চট্টগ্রাম জেলার মিরেরশরাই থানা হতে টেকনাফ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, মাইওনী ও ফটিকছড়ি থানায় ঘুরে ঘুরে সকল কর্মী ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার সংবাদ দেই। এর মধ্যে দেখতে পেলাম একমাত্র মৌলভী সৈয়দ আহমেদ ও শাহজাহান ইসলামাবাদী ছোট ছোট আক্রমণ পরিচালনা করছেন। ১ মাস ১৭ দিন ভ্রমণের মধ্যেই কয়েকজন ছাত্র নিয়ে পটিয়া তহশীল অফিস, ষোলশহর তহশীল অফিস, আনোয়ারা থানা তহশীল অফিস ও আরো কয়েকটি তহশীল অফিস জ্বালিয়ে দেয়া হয়। প্রফেসর নূর মোহাম্মদ ও ওবায়দুল্লাহ মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে আমি হরিনা ক্যাম্পে যাই। এর মধ্যে কয়েকজন যুবককে আমি ভারত পাঠাই। কিন্তু পথিমধ্যে মিজো ও পাঞ্জাবীদের দ্বারা আক্রমণে হারুন ও ফরিদ নামক দু’জন যুবক নিহত হয়। বাকী যুবকরা ভয়ে ফিরে আসে। বাংলাদেশ থেকে নিরাপদে কিভাবে যুবকদের ভারতে নিয়ে যাওয়া যায় সে জন্যে মেজর রফিক, ক্যাপ্টেন এনাম, ক্যাপ্টেন মাহফুজ, এম, এ, হান্নান, সাবের, ইউসুফ, অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে এক আলোচনা সভা বসে। এই আলোচনার পর মেজর রফিক আমাকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ প্রতিটি থানার মানচিত্র নেয়ার দায়িত্ব দেন। কোঅপারেটিভ বুক সোসাইটি হতে সমগ্র চট্টগ্রামের মানচিত্র সংগ্রহ করি। প্রত্যেক সি ও এর কাছ থেকেও মানচিত্র সংগ্রহ করি এবং লোক মারফতে ওপার বাংলায় মেজর রফিকের কাছে প্রেরণ করি। এ সময় আমার খালুর সঙ্গে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরাফেরা করি এবং অনেক পাক সৈন্যের সঙ্গে পরিচয় হয়। একদিন ব্রিগোর্ডিয়ারের অফিসে ঢুকে দুটো আর্মী ম্যাপ সংগ্রহ করে সেখান থেকে সরে পড়ি।

 এর কয়েকদিন পরে দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে ৪৪/৪৫ জন ছেলে এবং উত্তর চট্টগ্রাম থেকে ৪০/৪৫ জন ছেলে সংগ্রহ করে তাদেরকে ভারতে প্রেরণ করি। আমিও ভারতে চলে আসি। সঙ্গে আনা আর্মী ম্যাপটা মেজর