পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১১৬

 জনাব এম এম ওয়াশিংটনে এসে কয়েকটি কাজ করার চেষ্টা করেন। তিনি সব জায়গায় প্রচার করতে থাকেন যে অবস্থা যত খারাপ বলা হচ্ছে মোটেই ততটা খারাপ নয়, আওয়ামী লীগের সমর্থন সর্বব্যাপী নয়, তাছাড়া বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলাপ আলোচনা শুরু হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জানান যে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান একান্ত প্রয়োজনীয়। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা মার্চের ‘গণ্ডগোলের’ ফলে খারাপ হয়ে গেছে। অতএব ঋণ শোধের সময়সীমা বাড়িয়ে দেয়া হোক।

 জনাব এম এম আহমেদের সঙ্গে পূর্ব থেকেই আমার আলাপ ছিল এবং তাঁর সাথে এক দীর্ঘ বৈঠক হয়। সেখানে আমরা খোলাখুলিভাবে আলাপ করি। তিনি খোলাখুলি বলেন যে, নির্মম এবং দুঃখজনক ঘটনা চতুর্দিকে ঘটেছে ব্যাপকভাবে। সবার মানসিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ এবং বাঙ্গালীদের মনোভাব সহজে অনুমেয়। মার্চের ঘটনার পর যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা সারানো সত্যিই একটি সমস্যা হবে। তিনি আরো বলেন যে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করতে আসলেই আগ্রহী। তিনি একদল মধ্যপন্থী আওয়ামী লীগের লোকজন খুঁজছেন এবং অবশ্যই ৬ দফাতে যতদূর সম্ভব মেনে নেয়া হবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে ইয়াহিয়া খান আসলেই কি যা চেষ্টা করছেন তা করতে পারবেন। তিনি বলেন যে সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত কোন উত্তর দিতে পারছেন না। সেটি একটি কঠিন সমস্যা বটে। এম এম আহমেদ আরো বলেন, মার্চ মাসে যখন ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা চলছিল তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবগুলো কার্যকরী কিনা। তিনি বলেছিলেন যে, প্রস্তাবগুলি কার্যকরী করা সম্ভব তবে সামান্য যৌক্তিকীকরণের প্রয়োজন রয়েছে। যেমন প্রতিরক্ষার জন্য শিল্পখাত এবং কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন কেন্দ্রের হাতেই থাকবে। বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপারে দুটি এ্যাকাউণ্ট তখনই সম্ভব নয়, তবে ভবিষ্যতে হতে পারে। বিদেশী সাহায্য সংক্রান্ত আলাপ আলোচনা প্রদেশভিত্তিক হওয়া উচিত নয়। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে সাহায্যকারীর সাথে আলাপ শুরু করার আগে ভিন্ন প্রদেশের প্রয়োজন এবং দাবীগুলো সম্পর্কে একমত হওয়া যেতে পারে ও তার ভিত্তিতে আলোচনা হতে পারে। ইয়াহিয়া খান তাঁকে ভুট্টোর সঙ্গে আলাপ করতে বলেন। কিন্তু ভুট্টো কেবলমাত্র রাজনীতি নিয়েই আলাপ করতে চান। তিনি বলেন যে তার মতে ভুট্টো প্রস্তাবগুলো মেনে নিতে কোনক্রমেই রাজী ছিলেন না। যদিও তিনি (এম এম আহমেদ) আমাকে জানান যে ২৫শে মার্চের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিল না যে এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে, আমার বিশ্বাস, তিনি ঢাকা ত্যাগের আগেই তার আভাস পেয়েছিলেন। ব্যক্তিগত পরামর্শ হিসেবে তিনি আমাকে জানান যে দেশে ফিরে যেতে চাইলে আমি কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম-সচিব হিসেবে কাজ করতে পারি।

 মে মাসের শেষের দিকে আমেরিকার কংগ্রেসে ফরেইন এ্যাসিসটেন্স এ্যামেণ্ডমেণ্ট প্রস্তাব পেশ করা হয়। সিনেটে স্যাক্সাবি-চার্চ প্রস্তাবে পাকিস্তানে সব সাহায্য বন্ধ করার দাবী করা হয়। আর হাউস অব রিপ্রেজেণ্টেটিভে গ্যালাগার প্রস্তাবে একই দাবী উত্থাপন করা হয়। এদিকে দূতাবাসের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে পড়ে। বহু লোককে চাকুরীচ্যুত করা হচ্ছিল। আমরা দেশের কোন খবরই পাচ্ছিলাম না এবং আমাদেরকে কোন কাজও করতে দেয়া হচ্ছিল না। বহু পাকিস্তানীকে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং তারাই সব কাজ করতো। এ সময় দূতাবাসের উপ-প্রধান জনাব এনায়েত করিম হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তিনি ছিলেন বাঙ্গালীদের মধ্যে সর্বোচ্চ কর্মকর্তা।

 ২৯শে মে শনিবার বিচারপতি চৌধুরীর সাথে নিউইয়র্কে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। একই সময় জনাব এফ আর খানের নেতৃত্বে শিকাগোয় ডিফেন্স লীগ অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। মোটামুটি এ রকম চিন্তা করা হয় যে এই সংগঠনটি আমেরিকার বিভিন্ন বাঙ্গালী সংগঠনের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করবে। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেণ্টারও এই সময়ে প্রতিষ্টিত হয়। কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে যে সমস্ত আমেরিকান ডাক্তার কোনও না কোন সময়ে কাজ করতেন তারা এই সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন। সবার সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, মাহমুদ আলী (নিউইয়র্কে) গঠিত সংগঠনকে আর্থিক সাহায্যদান করা হবে এবং আমি কোন একটি বাঙ্গালী সংগঠনে ১৫ই জুন যোগদান করবো। ৬ই জুন শিকাগোতে জনাব এফ আর খানের বাসায় একটি সভা