পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১১৯

 এর কিছু দিন পর শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কিত খবর আসে। আমরা এর বিরুদ্ধে জোর তৎপরতা চালাতে থাকি। এর বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়ে হয়ে। বেশ কিছু কংগ্রেস সদস্য বিবৃতি দেন এবং এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আগষ্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে আমরা ব্যস্ত ছিলাম বিভিন্ন জায়গায় সভা সমিতি করার মধ্যে। অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল এবং আমরা সেই সব জায়গায় গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি ও প্রবাহ ব্যাখ্যা করতাম। ৩রা সেপ্টেম্বর ডাঃ মালিক গভর্ণর হন। কিছুদিন পর একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে যা পরবর্তীকালে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

 লস এঞ্জেলস, সানফ্যান্সিসকো, ডেনভার এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সভা করি। ফিলাডেলফিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান “ফ্রেণ্ডস অব ইষ্ট বেঙ্গল” খুবই সক্রিয় ছিল। সেখানে সুলতানা ক্রিপেনডরফ এবং মাজহারুল হক একটি “টিচ-ই” -এর ব্যবস্থা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মিঃ চার্লস কান এর উদ্যোক্তা ছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে কয়েকজন পাকিস্তানীও এত বাংলাদেশের সমর্থনে অংশগ্রহণ করেন যথা জনাব এজাজ আহমদ। পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সাহায্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে ঐ সময়ে। সিনেটে এ বিষয়ে তর্কবিতর্ক চলে। অনেকেরই মত ছিল যে খাদ্য সরবরাহকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখা উচিত। আমরা যুক্তি দেখাই এ সাহায্য দিলে যে হত্যাযজ্ঞ চলছে তা কখনো বন্ধ হবে না। বরং এতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাহায্যই হবে।

 একই সময়ে পাকিস্তান সাহায্য গ্রুপের মিটিং হয়। আমরা বিভিন্ন মহলে এর বিরুদ্ধে তদবির করতে থাকি। হারুনুর রশীদ ও রেহমান সোবহান এ ব্যাপারে খুব সচেষ্ট ছিলেন। পাকিস্তান চাচ্ছিল তাদের দুশ চল্লিশ মিলিয়ন ডলার মওকুফ করে দেয়া হোক। আমেরিকা এতে রাজী হচ্ছিল না এবং চাপ দিচ্ছিল একশ’ মিলিয়ন ডলার দাবী থেকে কমিয়ে নেবার জন্যে। শেষ পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই মিটিং শেষ হয়। এখানে একটা বিষয় বলা দরকার। ইউ, এস, এইডের প্রতিনিধি মরিস উইলিয়াম প্রথমে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ঢাকা সফরের পর তিনি বোধ হয় মত পরিবর্তন করেন। পরবর্তীকালে এণ্ডারসন পেপারস থেকে দেখা যায় যে পাকিস্তান সমর্থন নিতান্তই ওপরের তলার ব্যাপার ছিল। প্রেসিডেণ্ট নিক্সন আর তার উপদেষ্টা হেনরী কিসিঞ্জারই সে কার্যক্রমের হোতা ছিলেন।

 আগেই বলেছি জুন মাসের দিকে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ এনফরমেশন সেণ্টার স্থাপিত হয়। প্রথমে এটা পরিচালনা করেন মিসেস আনা টেইলর আর ডেভিড ন্যালিন। বাঙ্গালীদের মধ্যে রাজ্জাক খান ও তার বন্ধুবর্গ এবং মহসীন সিদ্দিকী এটা চালাতেন। এর প্রধান কাজ ছিল কংগ্রেসে লবি করা ও বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করা। এই সেণ্টারের সঙ্গে বাঙ্গালী জামান (কচি) এবং মার্কিন ডেভিড ওয়াইজব্রডের নামই প্রচার লাভ করে। এরা জুন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন ও তৎপরবর্তীকাল পর্যন্ত সক্রিয় থাকেন। আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা এই সংগঠনকে বাঁচিয়ে রাখেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র ও শিক্ষকেরা দল বেঁধে ওয়াশিংটনে এসে কেপিটল হিলে লবি করে যেতে এই সংগঠনের সাহায্য নিতেন। বোষ্টন, ইণ্ডিয়ানা, টেকসাস, শিকাগো, নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, ওহিয়ো, সানফ্রানসিসকো, লস এঞ্জেলেস এবং আরো অনেক জায়গা থেকে বাঙ্গালী ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকরা নির্দিষ্ট নির্ঘণ্ট অনুযায়ী ওয়াশিংটনে এসে লবি করতেন। আমরা সব সিনেটর এবং কংগ্রেসম্যানদের ফর্দ বানিয়ে নিশ্চিত করাতাম যে সবাইকে আমাদের বক্তব্য বলার সুযোগ হয়েছে। মূলতঃ মার্কিন নাগরিকরাই বেশী করে লবি করতো, বাঙ্গালীরা তাদের সঙ্গ দিতেন। আমার মনে হয় লবি দল হিসেবে আমরা বেশ সুগঠিত ও সুসংহত ছিলাম। আর এতে ছিল বাংলাদেশ মিশন ও ইনফরমেশন সেণ্টারের যৌথ প্রচেষ্টা। আমার মনে পড়ে কোনদিন বিকেলে হয়তো কেউ আমার বাসায় রাত্রি যাপনে আসলেন আর পরের দিন সকালেই কেপিটল হিলে চলে গেলেন এবং সেখান থেকেই বিকেলে বিদায় নিয়ে তার কর্মস্থলে ফিরে গেলেন। এরা নিজের ইচ্ছায় আসতেন, দেশপ্রেম তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। অক্টোবরে লবির কাজ তুংগে কারণ, তখন টারগেট ছিল বৈদেশিক সাহায্য বিল।